দৃশ্যপট ১ঃ
আপনি কি সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে
পারেন যেন অপারেশনটা শুক্রবারের মাঝেই করা হয়? কান্না ভেজা কণ্ঠে বললো স্বপ্না।
ওপাশ থেকে ডাক্তার ভদ্রমহিলা বললেন যে দেখেন, এটাতো আমার এখতিয়ারের উপর না, এটা
নির্ভর করছে হসপিটালে বেড খালি হচ্ছে কী না তার উপর। বেড খালি হওয়া মাত্রই আমরা
আপনাকে জানাবো। কিন্তু আমি কি জানতে পারি যে আপনি কেন এত তাড়াহুড়া করছেন? আপনি কি
ইনফেকশনের আশংকা করছেন? সোমবার হলেও খুব একটা দেরী হবে না কিন্তু!
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো শম্পা।
বলবে না বলবে না করেও বলেই ফেললো--------দেখুন, আমি আমার সুপারভাইসরকে ব্যাপারটা জানাতে
চাই না। যদি শুক্রবারের মাঝে ডিএনসিটা হয়ে যায় তাহলে আমি উইকএণ্ডে রেস্ট নিয়ে
সোমবারেই কাজে যেতে পারবো। যদি সোমবারে করেন, তাহলে আমার ছুটি নিতে হবে, যেটা আমি
এড়াতে চাচ্ছি।
ভদ্রমহিলা শুনে আর কথা বাড়ালেন
না, বললেন আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।
ঘণ্টা দুয়েক পর হসপিটাল থেকে
ফোন আসলো যে বেড পাওয়া গেছে.........শুনে শম্পা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো!
মানুষের জীবন কত অদ্ভূত! এবারো
মা হওয়া হচ্ছে না এই অনুভূতির চেয়ে সুপারভাইসরকে ব্যাপারটা বলতে হবে না এই
অনুভূতিটা দেহ মনে স্বস্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে! গতবারের অভিজ্ঞতা মনে করলে এখনো গা গুলিয়ে
ওঠে শম্পার, একটা বিবমিষার অনুভূতি জাগলো। গতবার যখন জানিয়েছিলো যে ওর মাত্র একটা
মিসক্যারেজ হয়েছে, তাই সে ঊনার কয়েকটা ক্লাসে উপস্থিত থাকতে পারে নাই, ঊনি ওকে
‘প্রফেশনালিজমের’ উপর লেকচার দিয়েছিলেন ১০ মিনিট। তারপর থেকে ভদ্রলোককে স্রেফ
অমানুষ মনে হয় ওর। ডিপার্টমেন্টের নিয়মটা এমন যে ঊনার কাছে ওর জবাবদিহিতা করতেই
হবে, কোনো অন্যথা নেই।
জ্ঞান ফেরার পর ধাতস্থ হতে বেশ
কিছু সময় লাগলো শম্পার। ফুল অ্যানেস্থিশিয়ার অভিজ্ঞতা এই প্রথম, এর আগের বার যখন
মিসক্যারেজ হয়েছিলো, তখন ওষুধ দিয়ে লেবার পেইন ইন্ডিউস করে বের করেছিলো মাংসের
দলাটা, ডিএনসি করা হয় নি।
হুম, মাংস পিণ্ডই তো বলা যাবে
এটাকে, আল্লাহ সুবহানুহু ওয়া তা’লা প্রাণ দিলে সেটাই হতে পারতো তার সন্তান। হঠাৎ
মনে হল নামাযের ওয়াক্তের কথা। অস্ফুট কণ্ঠে রিয়াজকে ডাক দিলো। ওর বোধ হয় একটু চোখ
লেগে এসেছিলো, শম্পার ডাক শুনে ধরফরিয়ে উঠলো। শম্পা ওর মোবাইলের খোঁজ করলো। এক
সিনিয়র আপুকে মেসেজ দিয়ে রেখেছিল এই সময়ে নামায পড়ার নিয়মটা জানতে। দেখলো ঊনি
মেসেজ দিয়ে রেখেছেন যে যেহেতু প্রেগন্যান্সীর মেয়াদ ৭৯ দিন পার হয়ে গেছে, তাই এখন
নামাজ পড়তে হবে না......রেফারেন্সও দিয়েছেন। সেটা পড়ার এখন ধৈর্য্য হলো না শম্পার।
মনে হলো একটা ভার হাল্কা হয়ে গেলো। আর কোনো টেনশন নেই এখন, নিশ্চিন্তে রেস্ট নিতে
পারবে ও এই দুটো দিন.........দু চোখ বন্ধ করলো শম্পা......
দৃশ্যপট ২ঃ
কিছুটা দৌড়ে গিয়ে বাথরুমের
বেসিনে গিয়ে হরহর করে বমি করলো স্নিগ্ধা। এই গরমের মাঝে এতক্ষণ চুলার পাড়ে থাকার
জন্য নাকি পাশের বাসার খালাম্মার তির্যক মন্তব্যের জন্য, আল্লাহই জানেন, কিন্তু
বমিটা হয়ে শরীরটা একটু ভালো লাগছে। একটু শুবে ভেবেছিলো, কারণ আদনান ঘুমাচ্ছিলো,
কিন্তু ওর বমির শব্দেই হয়তোবা ভয় পেয়ে উঠে গেছে ও। আধো ঘুমের মাঝেই কাঁদতে কাঁদতে
পাশে মাকে খুঁজছে, তাড়াহুড়ো করে গিয়ে ওর পাশে শুলো, আস্তে আস্তে পিঠ চাপড়ে দিতে
থাকলো। ছেলে আবার ঘুমিয়ে গেলে সাবধানে উঠলো, খুব শুতে ইচ্ছা করলেও উপায় নেই। আরো ২
পদ রান্না তখনো বাকি। পেটে ৫ মাসের একটা আর কোলে ২ বছরের একটা নিয়ে একহাতেই
প্রতিদিন ৫ পদের মত রান্না করতে হয়। রোযার মাসে যেন খাওয়া দাওয়া আরো বেড়ে যায়
সবার! অদ্ভূত ব্যাপার! ৮জনের পরিবারের ৫ পদের মত রান্না করতে গিয়ে প্রতিদিনই
হাঁপিয়ে ওঠে স্নিগ্ধা। তাও ভাগ্যিস যে ও নিজে রোযা না। নিজে রোযা থাকতে হলে কী
অবস্থা যে হত! তবু মানুষের কথার শেষ নেই। ও কী তুমি রোযা করছো না! আমরা যে তোমাদের
বয়সে থেকেছি গো! শুনে পিত্তি জ্বলে গেলেও
চুপ করে ছিলো ও। যদিও মনে চাচ্ছিলো যে চিৎকার করে বলে যে আল্লাহ আমাকে যে অবকাশ
দিয়েছেন, আপনি সেটা কেড়ে নেয়ার কে, শুনি! কিন্তু চুপ করে থাকার এক অদ্ভূত ক্ষমতা
অর্জন করেছে ও গত তিন বছরে যৌথ পরিবারে সংসার করতে গিয়ে!
দৃশ্যপট ৩ঃ
আলহামদুলিল্লাহ! দুজনেই একসাথে
বলে উঠলো, ইমাম সাহেব যখন তাদেরকে সুন্দর করে ডিভোর্সের নিয়মটা বুঝিয়ে বললেন বুক
থেকে যেন কে এক মণি ওজন নামিয়ে দিলো!
রাত্রি আর সৈকত, সাথে ওদের তিন
বছরের ছেলে ফয়সাল এসেছিলো ইমাম সাহেবের সাথে কথা বলতে, লজ্জার মাথা খেয়েই এসেছিলো।
ঘটনাটা ঘটেছিলো একদম হুট করেই।
ইদানিং মন-মেজাজ মারাত্মক খারাপ থাকে রাত্রির। মিসক্যারেজটা হওয়ার পর থেকে লক্ষ্য
করেছে যে মেজাজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে, বিশেষ করে মাসের নির্ধারিত
সময়টাতে......ইদানিং অনেক দীর্ঘ সময় ধরে এটা থাকে, মাত্রাটাও আগের চেয়ে কয়েক গুণ।
বিদেশের সংসারে এক হাতে সব করতে গিয়ে ছেলের সব দুষ্টুমিই ইদানিং অসহ্য লাগে,
সৈকতের সাথে খিটমিটটাও অসহনীয় মাত্রায় চলে যাচ্ছিলো। নিজে যে একটা চরম বিরক্তিকর
মানুষে পরিণত হচ্ছে এটা নিজেই টের পাচ্ছিলো রাত্রি।
সরকারী ছুটির দিন, সৈকতও
বাসাতেই ছিলো। কিন্তু কোথায় বাসায় থেকে ছেলেকে একটু সময় দিবে, তা না......সকাল
থেকে ল্যাপটপেই মুখ গুঁজে আছে। সেটা দেখে প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হলেও চুপ করেই ছিলো
রাত্রি। মাত্রই সব কিছু গুছিয়ে দুপুরে একটু শুতে গেছে, ছেলের তখন খেলার ঝোঁক
উঠেছে.........কিছুতেই শোবে না। সৈকত বাসায় আছে, ও দেখবে মনে করে একাই শুয়েছিলো
রাত্রি, চোখও লেগে এসেছিলো!
ধরাম করে একটা শব্দ শুনে চমকে
উঠে ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখে তার গুণধর পুত্র একা একাই টিভি ওন করতে গিয়ে টিভির
উপরের শখের ফুলদানীটা ফেলে দিয়েছে, সাথে পুরা ড্রয়িং রুমের কার্পেট পানিতে ভেজা।
সাবান পানি দিয়ে খেলেছে একা একা। সৈকতের টিকিটা দেখা যাচ্ছে না, নিশ্চয়ই স্টাডি
রুমে এখনো ল্যাপটপ নিয়েই বসে আছে!
এই অভিনব দৃশ্য দেখে কোথা থেকে
কী হয়ে গেলো রাত্রির......মাথায় যেন রক্ত উঠে গেলো......ছেলেকে ধরে দিলো মাইর!
ছেলেও মায়ের এমন অগ্নিমূর্তি দেখে ভয় পেয়ে গগন বিদারী চিৎকার দিয়ে উঠলো। সেই
কান্না শুনে সৈকত এসে ছেলেকে রাত্রির হাত থেকে জোর করে কেড়ে নিতে গিয়ে রাত্রির
গায়েই হাত তুলে বসলো!
রাত্রি তখন স্রেফ জ্ঞান শূন্য।
সৈকতের উপর জমে থাকা সারাদিনের রাগ ফুঁসে উঠলো, প্রচণ্ড রেগে গিয়ে বলে উঠলো যে
তোমার সংসারের নিকুচি করি আমি......বলে গাড়ির চাবিটা নিয়ে ঝড়ের বেগে বাসা থেকে
বেরিয়ে যেতে ধরলো। সৈকতেরও মাথায় কী ভুত চাপলো, ও বলে বসলো যে বেরিয়ে যে যাচ্ছো,
এটাই শেষবারের জন্য বেরিয়ে যাওয়া এটা মনে থাকে যেন, তোমাকে ডিভোর্স দিচ্ছি, তোমার
মত hot headed একটা মানুষের সাথে সংসার করতে
করতে আমারো নাভিঃশ্বাস উঠে গেছে.........
অবশ্যই রাত্রি আর সৈকত কেউই
ভেবে চিন্তে বলে নি, যা বলেছে রাগের মাথাতেই বলেছে। পরে দুজনেই খুব অনুশোচনাতে
ভুগছিলো, বুঝে উঠতে পারছিলো না যে কী করা উচিৎ। একই শহরে চাচার বাসা আছে, সেখানে
গিয়ে চাচা-চাচীকে সব খুলে বলার পর ঊনারাই ইমাম সাহেবের সাথে কথা বলানোর ব্যবস্থা
করলেন।
ইমাম সাহেব সব শুনে বললেন যে মাসের
বিশেষ সময়টাতে তালাক্ব দেয়াই নিষেধ। এ সংক্রান্ত নিয়ম গুলো আসলে সবারই ব্যাসিক জ্ঞান
হওয়া উচিৎ। কিন্তু দিয়ে যখন ফেলেছে তখন এক তালাক্ব কার্যকর হয়েছে, ইদ্দতকাল এখনো
চলছে দেখে মিটমাটের জন্য আলাদা করে কিছু করতে হবে না, ওদের ইচ্ছাটাই যথেষ্ট। ভদ্রলোক
বেশ বিচক্ষণ। অতি সত্ত্বর রাত্রিকে ডাক্তার প্লাস কাউন্সেলরের কাছে যেতে বললেন,
কারণ ঊনার ধারণা হরমোন্যাল ইমব্যালেন্স থেকে রাত্রির এমন হচ্ছে। ওদের দুজনকেই এরপর সাবধান
হয়ে যেতে বললেন, কারণ রাগের মাথায় উচ্চারণ করা তালাক্বও কার্যকর হয়ে যায়
যদি না ব্যক্তি একেবারেই হিতাহিত জ্ঞান শূন্য থাকে.........
শুনে ওরা দুজনেই মাথা নাড়লো।
সাবধান হতে হবে, আর চিকিৎসাও করাতে হবে যাতে এভাবে রাত্রি মেজাজের উপর নিয়ন্ত্রণ
না হারিয়ে ফেলে সেজন্য.........
২য় ও শেষ পর্ব এখানে
No comments:
Post a Comment