আমি এখানে আমার প্রতিবেশীদের
মাঝে যে হালাক্বা নেই, সেখানে একটা ভিডিও দেখানোর পর একবার এক ভাবি জিজ্ঞেস করলেন
যে আল্লাহকে কিভাবে ভালোবাসবো! যা করি তা তো জান্নাতে যাওয়ার জন্য করি, জাহান্নাম
থেকে বাঁচার জন্য করি, আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার কোনো অনুভূতি তো কখনো আসে না......শুনে
আমি ঊনাকে বললাম যে আমাদের আল্লাহ কে এটা জানতে হবে, ঊনার সৃষ্টি বৈচিত্র্য দেখতে
হবে ব্লা ব্লা। আল্লাহকে যত চিনবো, তত ঊনাকে ভালোবাসতে পারবো ইনশাল্লাহ। কথাগুলো
বলছিলাম ঠিকই, কিন্তু নিজের কানেই কেমন বেসুরো ঠেকছিলো। মনে হচ্ছিল আমি ঊনাকে যা
বলছি সেগুলো স্রেফ থেওরী আওড়াচ্ছি।
জীবনের একটা সুদীর্ঘ সময় আমি
ভাবতাম যে ইসলাম যে সত্য ধর্ম এটা বোঝার সঠিক উপায় এটা না যে আমরা এটার আইন কানুন
গুলো নিয়ে বিশ্লেষণ করবো। কারণ আমাদের সীমিত বুদ্ধি দিয়ে আমরা সবসময় এগুলোর পেছনের
প্রজ্ঞা বুঝতে পারবো না......কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে নানা ঘটনায় আমার মনে হয়েছে যে
ইসলামী নানা আইনগুলোর মাঝে আল্লাহর যে পরিচয় ফুটে উঠেছে সেটা আমার মাঝে ঊনার জন্য
অদ্ভূত এক অনুভূতি সৃষ্টি করছে......সেই অনুভূতিটা কৃতজ্ঞতার সীমা ছাড়িয়ে অন্য
কিছু......হুম, সেটা ভালোবাসার অনুভূতি।
আগের পর্বে যে কাহিনী গুলো তুলে
ধরেছি সেগুলো অধিকাংশই আমার উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা। কিন্তু আমি এখানে শুধু মেয়ে
বান্ধব মাসআলাগুলোর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছি। ধীরে ধীরে, নানা
অভিজ্ঞতার আলোকে এই উপলব্ধিটা আমার হয়েছে যে কিছু কিছু সময়ে যখন দুনিয়ার কেউ ছাড়
দেয় না, তখন আল্লাহ ছাড় দেন। একজন নারী তার মা হওয়ার পরিক্রমার মাঝ দিয়ে নানা
ধরণের মানসিক এবং শারীরিক জটিলতার মাঝ দিয়ে যান যেটা আমাদের সমাজ বিবেচনা তো দূরে
থাক, Acknowledge ই করে না! অথচ আমার রাব ঠিকই
জানেন যে এই সময়টা কঠিন একটা সময়। মাসের বিশেষ সময়টাতে সালাত আদায় করতে হয় না,
রোযা রাখতে হয় না, তালাক্ব কার্যকর হয় না..... গর্ভাবস্থায় কিংবা বাচ্চা দুধ খাওয়ার বয়সী হলে রোযা না রাখার অবকাশ
আছে..... The list can go on and on……
আমার মনে আছে যে আমি যখন ক্লাস
ফাইভে পড়ি, তখন আম্মার ইউট্রাসে একটা টিউমার হয়েছিলো, জরায়ু আর ডিম্বাশয় দুটাই
ফেলে দিতে হয়েছিলো। তারপর থেকে আম্মার মাঝে নানা ধরণের পরিবর্তন এসেছিলো। মাত্র
চল্লিশ পেরোনো আম্মার তখন অনেক হট ফ্লাশ হত, একটুতেই রেগে যেতেন। আম্মার এই অকারণ
রাগ করার স্বভাবে অভিমান হত খুব, উল্টা আম্মার সাথে চিল্লাচিল্লি করতাম।
আজকের আমি যখন পিছন ফিরে তাকাই,
তখন আমার তীব্র আফসোস হয়। আম্মা যে আসলে তখন কত ধরণের হরমোনাল ইমব্যালন্সের মাঝে
দিয়েই যাচ্ছিলেন! আম্মা নিজেও কি তা জানতেন! যদি জানতেন তাহলে নিজে হয়তো একটু
সচেতন হতে পারতেন, আশে পাশের মানুষগুলো তাকে ভুল কম বুঝতো, সম্পর্কগুলো হয়তো এত
তিক্ত রূপ নিতো না......
নানা প্রোপাগাণ্ডার সম্মুখীন
হয়ে বহু শিক্ষিত মেয়েকে আমি দেখেছি মনে প্রাণে এটা বিশ্বাস করতে যে ইসলামে
নারীদেরকে যথাযথ মর্যাদা দেয়া হয় নাই। আমি যখন উপরে উল্লেখিত আইনগুলোকে For granted হিসেবে না নিয়ে এই আঙ্গিকে দেখা শুরু করলাম তখন আমি
আবার নতুন করে উপলব্ধি করলাম যে নিশ্চয়ই ইসলাম এমন এক সত্ত্বা থেকে আগত যিনি আমাকে
সৃষ্টি করেছেন, আমার কষ্টগুলো বোঝেন এবং সেই অনুযায়ী আমাকে ছাড় দেন। চিন্তা করে
দেখুন তো যে দুনিয়ার কোনো প্রতিষ্ঠান আপনাকে ছাড় দেবে মাসের বিশেষ সময়গুলোতে? হয়তো
তীব্র তলপেটের ব্যথায় আপনার দম নিতেও কষ্ট হচ্ছে। তবু যেতে হবে অফিসে, স্কুলে,
সবখানে। রান্না করতে হবে, সন্তানদের দেখভাল করতে হবে.........শুধু কী করতে হবে না?
আল্লাহর প্রতি দায়িত্বগুলো! সেখান থেকে অব্যাহতি!
ফেসবুকে আমি অনেক সময় আমার
ব্যক্তিগত কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছি, আমার জীবনের কঠিন কিছু সময়ের ব্যাপারে কথা
বলেছি। সে কারণে কী না জানি না, তবে বহু বোন, যারা অনুরূপ অভিজ্ঞতার মাঝ দিয়ে
যাচ্ছেন, তারা আমাকে মেসেজ পাঠান পরামর্শের জন্য। মাঝে মাঝেই তাদের কারো কারো
কাহিনী শুনে আমার চোখ ভিজে আসে.........তারপর যখন আমি আমার নিজের জীবনের ঘটনা
ক্রমগুলো মনে করি, তখন আবার সাহস পাই...
ইসলামী জীবন দর্শনের যে দিকটা
আমার কাছে খুব অভিনব লাগে, সেটা হচ্ছে ‘Not having a
specific definition of blessing or test’। ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে
বলা দরকার। আমরা যখন দেখি যে কারো জীবনটা কানায় কানায় পূর্ণ, সন্তান, সম্পদ,
খ্যাতি এসব অনেক কিছুই আছে, আমরা ভাবি যে সে খুব blessed! কারো
জীবনে যখন কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, ধরেন সন্তান হচ্ছে না বা মারা গেছে বা অসুখ বিসুখ
ইত্যাদি, আমরা ভাবি যে they are going through test/difficulties. কিন্তু আমরা যদি কুরআনীয় দৃষ্টিভঙ্গী দেখি, তাহলে বুঝবো যে এগুলো কোনোটাই
কিন্তু সাফল্য বা পরীক্ষার মাপকাঠি নয়। ফিরাঊনের সব কিছু ছিলো তবু সে আল্লাহর চোখে
সবচেয়ে ঘৃণিত এবং অভিশপ্ত ব্যক্তি। আবার সূরা কাহফে মুসা আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং
খিদির আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাহিনী থেকে আমরা বুঝি যে আপাত দৃষ্টিতে খুব খারাপ কিছু
আসলে আমাদের ভালোর জন্য হতে পারে। ওই কাহিনীর সবচেয়ে বড় শিক্ষণীয় আমার কাছে হচ্ছে-
কোনো খারাপ কিছু ঘটার মাঝে কী প্রজ্ঞা ছিলো এটা আমি এই জীবনে টের পেতে পারি,
যেমনটা নৌকার মালিক পেয়েছিলো, আবার নাও পেতে পারি, যেমনটা খিদির আলাইহি
ওয়াসাল্লামের যে বাচ্চাটাকে হত্যা করেছিলেন, তার মা-বাবা কখনোই বোঝে নি!
আমি আমার নিজের প্লাস চারপাশের
বহু, বহু মানুষের অভিজ্ঞতা এবং রিভার্ট মুসলিমদের অসংখ্য কাহিনী থেকে একটা জিনিস
গভীরভাবে উপলব্ধি করেছি যে যখনই কেউ আল্লাহর পথে চলা শুরু করে, সে নানা কঠিন
পরিস্থিতির মাঝ দিয়ে যায়। এই ব্যাপারটা অনেকের কাছেই খুব কনফিউসিং লাগে যে বান্দা
যখন আল্লাহর ইবাদাতে মনোযোগী হয়, তখন আল্লাহ সেটা সহজ না করে দিয়ে বরং নানা বিপদ
আপদের মাঝে কেন ফেলেন।
আমাদের এখানে একটা জিনিস বোঝা
খুব জরুরী যে আল্লাহর সাথে আমাদের সম্পর্কের সীমা কিন্তু দুনিয়ার মাঝেই শুধু আবদ্ধ
না। This life, by definition is Unjust. তাই
আমরা যখন আল্লাহকে চিনবো, তখন আমরা পরকালের প্রয়োজনীয়তা এবং সত্যতা উপলব্ধি করবো।
আমাদের প্রাপ্তি/ অপ্রাপ্তিগুলোর হিসাবের সীমা পরিব্যপ্ত হবে সেই জীবন পর্যন্ত।
যদি দুনিয়ার সীমার বাইরে আমরা চিন্তা করতে না পারি, তাহলে নিচের আয়াতটা আমাদের
জন্য একটা সতর্ক বাণী হতে পারে-
মানুষের মধ্যে কেউ কেউ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে জড়িত
হয়ে আল্লাহর এবাদত করে। যদি সে কল্যাণ প্রাপ্ত হয়, তবে এবাদতের উপর কায়েম থাকে এবং যদি কোন পরীক্ষায় পড়ে, তবে পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়। সে ইহকালে ও পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত। এটাই
প্রকাশ্য ক্ষতি (২২:১১ )
আমাদের যদি মনে হতে থাকে যে
আল্লাহর ইবাদাত করছি সেটার বিনিময়ে আল্লাহ দুনিয়াতে সব কিছু সহজ করে দিবেন, তাহলে
আমাদের বোঝায় কিছু ভুল আছে। আল্লাহ কোথাও বলেন নি যে দুনিয়াতে সব কিছু সহজ হয়ে
যাবে। বরং উলটাটা বলেছেন যে আল্লাহর যে বান্দা যত কাছের, তার পরীক্ষা তত বেশী।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন এক্ষেত্রে খুব Iman boosting হতে পারে, যখন আমরা দেখি যে ঊনি কী সীমাহীণ কঠিন
সময়ের মাঝ দিয়ে গেছেন!
আমার কথাগুলো খাপছাড়া মনে হচ্ছে
কী না জানি না, কিন্তু আমরা যারা আল্লাহর পথে অটল থাকতে গিয়ে/ থাকা সত্ত্বেও নানা
কঠিন সময়ের মাঝ দিয়ে যাচ্ছি, তাদের জন্য আল্লাহর এই Merciful দিকটা উদ্ভাবন খুব কার্যকরী হতে পারে। আমার জীবন এমন
একজনের দ্বারা ডিজাইন করা যিনি আমাকে সবচেয়ে ভালোবাসেন-------এই বোধটা কি আমাদের
একটু স্বস্তি দিতে পারে?
আজকের আমি যখন পিছন ফিরে তাকাই
তখন আমি অবাক হয়ে উপলব্ধি করি যে আপাত দৃষ্টিতে যেগুলো আমার জন্য ছিল খুব কঠিন
কিছু মুহুর্ত, সেই সময়টাতেই আমি আল্লাহর সবচেয়ে কাছাকাছি যেতে পেরেছিলাম। আমার
যেটুকু কুরআন এখন মুখস্ত আছে, সেটার ৯০% হয়েছিলো সেই সময়ে। কুরআন আমাকে তখন জীবনের বাস্তবতা ফেস করার শক্তি
যুগিয়েছিলো। আলহামদুলিল্লাহ আমার মুভি, জ্ঞান, আড্ডা এসব কোনো Escape এর দরকার হয় নি।এই দুই এর মাঝে পার্থক্যটা বোঝা খুব
দরকার। কারণ আজকাল আমরা অধিকাংশই বড্ড বেশী Escape খুঁজি।
নিজের মনের শান্তি খুঁজে ফিরি সম্পর্ক, বস্তু ইত্যাদির মাঝে। ভুলে যাই যে শান্তির
উৎস আস-সালাম যেটা আল্লাহর একটা নাম।আল্লাহ শান্তি পাবার উপায় কুরআনে দ্ব্যর্থহীণ
ভাষায় জানিয়ে দিচ্ছেন-
জেনে রাখ, আল্লাহর যিকির দ্বারাই অন্তর সমূহ শান্তি পায়। (১৩:২৮)
তাই আজকের আমার মনে হয় ওগুলো
আসলে পরীক্ষা ছিলো না, বরং আল্লাহর রহমত ছিলো, কারণ নানা নিয়ামতের ভিড়ে আজ আল্লাহর
সাথে সেই সম্পর্কটা অনেকটাই দুর্বল হয়ে গেছে। তখন যেভাবে আল্লাহর উপর ভরসা করতে
পারতাম, এখন সেভাবে পারি না, জীবনে একটু অনিশ্চয়তা আসলেই টেনশন লাগতে থাকে!
তাই আমার যেসব বোনেরা নানা কঠিন
সময় পার করছেন, তাদেরকে জড়িয়ে ধরে আমি বলতে চাই যে নিশ্চয়ই আল্লাহ রাহমানুর রাহীম,
ঊনি আমাদের নিয়্যত, ঊনার সাথে সম্পর্ক পরিশুদ্ধ করার জন্য দুনিয়াবী কিছু জিনিস
কেড়ে নিচ্ছেন। তার বিনিময়ে ঊনি আমাদেরকে হিদায়াত দিয়েছেন যেটার মূল্য পৃথিবীর কোনো
সম্পদ দিয়ে মাপা সম্ভব না।
আসুন একবার বুকের গভীর থেকে বলি
যে নিশ্চয়ই আল্লাহকে রাব, ইসলামকে দ্বীন এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লামকে রাসূল হিসেবে পেয়ে আমি সন্তুষ্ট। তারপর অবনত চিত্তে বলি যে ইয়া
রাব্বি (O my lord), ভালোবাসি তোমাকে......For
designing my life in the best possible way 😊
No comments:
Post a Comment