Tuesday, July 2, 2019

ইন্দ্রিয়ের সীমানা পেড়িয়ে.........

( লেখাটা ২০১৩ সালে লেখা, মিশরে মুরসি সরকারের পতনের সময়ে)


আমি তখন ইসলামে মাত্র হাঁটি হাঁটি পা। ইসলাম যে স্ট্রাকচারডভাবে শেখার জিনিস, তা আমার মস্তিষ্কের কোন অণু পরমাণুতেও নেই। সারাদিন শেখ গুগলের কাছে (মানে ইন্টারনেট) এটা ওটা জানতে চাই। ফেসবুকে রাজ্যের ইসলামী গ্রুপের মেম্বার। তো হঠাৎ করে একদিন একটা পাওয়ার পয়েন্ট প্রেসেন্টেশন পেলাম কই যেনো, সেখানে বিজ্ঞানসম্মতভাবে, ছবি দিয়ে দারুণ করে বুঝানো হয়েছে যে কেন ইসলামিক ভাবে পশু জবাই করার পদ্ধতি পশুদের জন্য সবচেয়ে কম কষ্টদায়ক এবং স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।

খুব একটা পশুপ্রেমী আমি কখনোই ছিলাম না যে ওদের কষ্ট কম হয় শুনে আমি হাফ ছেড়ে বাঁচব। তাই ব্যাপারটা আমাকে খুব একটা আন্দোলিত করে নি।বরং ওই প্রেসেন্টেশনটার মূল বক্তব্য ছাপিয়ে আমার ব্রেনে অনুরণন সৃষ্টি করেছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা বিষয়। আর তা হলআমাদের ইন্দ্রিয়গত সীমাবদ্ধতাআমার কাছে আপাতদৃষ্টিতে যা খুব নিষ্ঠুর মনে হচ্ছে, আসলে তা ভুল! অন্যদিকে আমি ভাবছি যদি পশুটাকে গুলি করে মেরে ফেলি, তাইলে তার কষ্ট কম হবে, কিন্তু আসলে তাতেই তার ভয়াবহ কষ্ট হবে!

আমার ইসলাম শিক্ষার প্রাথমিক যুগে দেখলেও এই বিষয়টা পরবর্তীতেও আমাকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছে। একবার দুবার নয়, একাধিকবার। গত কদিন ধরে মিশরে কুকুর বিড়ালের মত মুসলিমদের মরতে দেখে আবার চিন্তাটা আমার মাঝে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে!

চিন্তা করুন এরকম কোনো একটা করুণ মৃত্যুর কথা-------যখন আপনাকে গুলি করে ফেলে চলে গেছে, অধিক রক্তক্ষরণজনিত কারণে আপনার মৃত্যু হচ্ছে। কিংবা ভাবুন কুরআনে বর্ণিত গর্তবাসীদের (আসহাবুল উখদুদ-সূরা বুরুজে বর্ণিত) কথা, যাদের তাদের ঈমানের জন্য আগুনে পুড়িয়ে মারা হচ্ছিল.........কিংবা হামযা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর কথা, যার মৃত্যুর পর মৃতদেহ নৃশংসভাবে ক্ষত বিক্ষত করা হয়েছিল...এই সব কিছুই কি আমাদের চর্ম চোখে দেখা না? কিন্তু আমরা এই যে খালি চোখে যা দেখছি, তাই কি নিশ্চিত বাস্তবতা? যেসব উদাহরণগুলো বললাম, সেগুলো আপাত দৃষ্টিতে খুব কষ্টদায়ক মনে হলেও, আমরা কি আসলে জানতে পারছি যে যারা মারা গিয়েছেন তাদের কেমন অনুভূতি হয়েছিল? আগুনে যখন ছুঁড়ে ফেলা হল, তখন তাদের কি আদৌ কষ্ট হয়েছিল, নাকি প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ফেরেশতারা তাঁর আত্মাটা সাত আকাশের উপরে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাড়াকাড়ি লাগিয়েছিল? যেসব লাশ দেখে হয়ত আমাদের ঈমান দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, তারা আসলে কি অসাধারণ আতিথেয়তার মাঝ দিয়ে যাচ্ছেন তা কি উপলব্ধিতে আসে আমাদের?

আসলে  ইন্দ্রিয়ের সীমানা পেরিয়ে এই যে অনুভূতিগুলো............এটাকেই কিন্তু কিতাবী ভাষায় বলে গায়েবে বিশ্বাস, যেটা কিনা আমাদের ঈমানের অপরিহার্য অংশ। একজন মা যখন তার সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেন, তখন সেটা তার জন্য প্রতি মুহুর্তে লালন করা এক তীব্র অনুভূতি। অথচ, আমাদের কারোরই কিন্তু সেই জীবনের কথা মনে নেই। কবরের জীবনটাও ঠিক এমনই। যারা প্লেন ক্র্যাশ করে মারা যায় তাদেরতো আর কবর দেয়া হয় না...তাহলে তাদের আযাব কিভাবে হয়, কিংবা কবরস্থ মানুষগুলো কিভাবে এতদিন আছে.........মারা তো গেছে অনেক দিন আগে...ইত্যাদি কথাগুলো যারা তোলে, তারা আসলে কেন এমন বলে? কারণ একটাই- তাদের ইন্দ্রিয়ের উপর তাদের অগাধ আস্থা। যা কিছু দেখছে, তাকেই তারা একমাত্র বাস্তবতা মনে করে! আর এজন্যই কাফিরদের একটা খুব কমন অব্জেকশন হচ্ছে-মরার পর তো আমার শরীর মাটির সাথে মিশে যাবে! কুরআনে আল্লাহ তাই বার বার তার সৃষ্টি জগতের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমাদের বুঝাতে চেয়েছেন আমাদের ইন্দ্রিয়ের সীমাবদ্ধতার কথা। আমাদের ইন্দ্রিয়ের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ বলেই আল্লাহকে depict করতে চাইলে আমরা তাকে আমাদের দেখা কোনো সৃষ্টির মত বানিয়ে ফেলি, যেটা কিনা ইসলামে সর্বোতোভাবে নিষিদ্ধ!
ফিরে আসি মিশরের কথায়। শুধু মিশর কেন, সিরিয়া, বার্মা......কোথায় নয়? সেদিন এক জায়গায় একটা দারুণ কথা পড়লাম-

১৯৪৮ সালে যখন মুসলিমদের পবিত্র ভূমি ফিলিস্তিনিদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে তখন ইরাকিরা ভাবেনি তাদের রক্ত ও একদিন(২০০৩) দজলা ফোরাত নদী দিয়ে প্রবাহিত হবে। যখন ইরাকিদের রক্ত দজলা ফোরাত দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে তখন সিরিয়ার মানুষও ঘুমন্ত ছিল। সিরিয়ার মানুষও ভাবেনি তাদের ভূমিও কিছুদিন পর আর এক নতুন ফিলিস্তিন,ইরাকের জন্ম দিবে। যখন (২০১১)সিরিয়ানদের রক্তে পবিত্র ভূমি আবার রঞ্জিত হয়েছে তখন মিশরীয়রা ভাবেনি তাদের রক্ত ও কিছুদিন পর নীল নদ দিয়ে প্রবাহিত হবে। আজ যখন মিশরীয়দের রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে নীল নদ দিয়ে, তখন উপসাগরীয় দেশগুলোর জনগণ হয়ত এখনো ঘুমন্ত। তারা হয়ত এখনো কল্পনা করতে পারতেছে না এরকম কিছু তাদের দেশে। কিন্তু তাদের একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না, যে রক্তের প্রবাহ ফিলিস্তিন থেকে শুরু হয়েছে, তা দজলা ফোরাত, নীল নদ হয়ে ভূমধ্যসাগরে গিয়েই থামবে না , তা আরব সাগর পর্যন্ত পৌঁছাবে। আর এই প্রবাহের সময় সবাইকেই তা ভিজিয়ে নিয়ে যাবে,কেউ রেহাই পাবে না। আর দুনিয়া ধ্বংস হয় খারাপ মানুষের খারাপ কাজের জন্য না, ঐ খারাপ কাজ দেখে ভালো মানুষের নীরব ভূমিকা পালনের জন্য।

৫ই মের নির্মম গণহত্যার পর এই কথাটার তাৎপর্য আমাদেরকে নিশ্চয়ই আর বুঝিয়ে বলতে হবে না!এইসব পরীক্ষার একটা ভালো দিক হচ্ছে এটা আমাদের ঈমানের অবস্থাকে প্রকাশ করে দেয়আমি যেদিন ফেসবুকে আসমা হোসেনের লেখা নোটটা পড়লাম, সেদিন আমি রাতে অনেকক্ষণ  ঘুমাতে পারি নি! আমি নিজেও এখন বিবাহিত, তাই তার অনুভূতি বোধহয় feel করতে পারছিলাম। আমি বারবার আমার স্বামীকে বলছিলাম------আমার জীবনে যদি এমন দিন আসে, আমি কি পারব এভাবে ধৈর্য্য ধারণ করতে?ওকে বলছিলাম, নিজেকেও প্রশ্ন করছিলাম। তখন এই ইন্দ্রিয়ের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার ব্যাপারটিই আমাকে সাহস জুগিয়েছে। আমার যদি দৃঢ় বিশ্বাস থাকে যে আমার স্বামী এখন খুব ভালো আছেন, এবং আমিও কিছুদিনের মাঝে তার সাথে গিয়ে মিলিত হব, যেখানে আমাদের বিচ্ছেদের আর কোনো আশংকা থাকবে না, তবে কেন নয়? কেন পারব না?

এই মিশরের ঘটনা থেকে আমি আরো একবার বুঝেছি কেনো মুসলিমরা এভাবে বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছে। মুসলিম ব্রাদারহুডের পদ্ধতিকে সঠিক মনে না করায় তাদের প্রতি আমাদের বিরক্তি এমন এক পর্যায়ে চলে গেছে যে তারা যে আমাদের মুসলিম ভাই, সেটাও আমরা বেমালুম ভুলতে বসেছি যেন! অনলাইনে কাঁদা ছোঁড়াছুঁড়ি চলছে, সবাই আগে থেকেই ঠিক বলে মনে করা উপসংহারে পৌঁছানোর প্রয়োজনীয় দলীল সংগ্রহ করছে এইসব ঘটনাবলী থেকে! সবারই নিজস্ব ব্যাখ্যা আছে! ফলশ্রুতিতে পদ্ধতি নিয়ে মতৈক্য থাকা ভাইদের বিরুদ্ধে আমি সমর্থন দিচ্ছি এমন ব্যক্তিদের, যারা ইসলামের প্রকাশ্য শত্রু! এই হচ্ছে আমাদের আল ওয়ালা আল বারার অবস্থা!  আমার স্বল্প জ্ঞানে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সালাফী পার্টি যদি সেনা সরকারকে সমর্থন না দিত, তাহলে হয়ত উৎখাতের ব্যাপারটা এত সহজে ঘটত না। ওরাই যখন আবার দেখল এই নৃশংস গণহত্যা, তখন সমর্থন প্রত্যাহার করে নিল।কী অদ্ভূত, তাই না! ( এই বিষয়টি আমাদের দেশের কন্টেক্সটে আরো অধিকভাবে প্রযোজ্য। জামাত শিবির সন্দেহে যে ছেলেটাকে পুলিশ অকারণে ধরে নিয়ে গিয়ে বিকলাঙ্গ করে দিচ্ছে, তার প্রতি যদি আমার সহমর্মিতা না থাকে, তবে বুঝতে হবে কোথাও সমস্যা আছে!)

আবার একইভাবে দেখলাম কিভাবে প্রচণ্ড জেনারালাইজেশনে ভুগছি আমরা! সৌদি সরকার একে সমর্থন দিয়েছে বলে সব সৌদি আলেমদের গালাগালি করা শুরু হয়ে গেল! আবারো মনে হল, কী অদ্ভূত আমরা আজকের মুসলিমরা!

তবে হ্যাঁ, একটা কথা- এইসব রাজনীতির কুটচক্রান্ত সবসময়ই খুব ধোঁয়াটে ছিল। এটা কিছুটা অবোধগম্য ছিল খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগেও। যারা ঐসময়ের ইতিহাস পড়েছেন, তারা এটা জানেন।

তাই আমি যেহেতু বিশ্ব রাজনীতির এইসব ঘোরপ্যাঁচের জন্য আল্লাহর দরবারে জিজ্ঞাসিত হব না, তাই আমি আপাতত যা আমার নিয়ন্ত্রণের মাঝে, তা পরিবর্তনের চেষ্টায় বেশী আগ্রহী। আমাদের সবার উচিৎ বনী ইসরাইলের সেই একজন ব্যক্তি হবার জন্য চেষ্টা করা, যার তাওবার জন্য আল্লাহ পুরা এলাকাটাতে বৃষ্টি দিয়েছিলেন। রাসূল সাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম এর মুসলিম উম্মাহ একটা দেহের মত- এই হাদীসটাকে আমি আজ থেকে অন্য চোখে দেখতে চাই। আর তা হল- শরীরের এক অংশের অনিয়ম যেমন বাকি অঙ্গকেও দুর্বল করে ফেলে, তেমনি, আমরা বাঙ্গালীরা যখন হিন্দী সিরিয়ালে পূজা দেখে আর ঈদে সানি লিওন ব্র্যান্ডের পোশাক কিনে সময় ও অর্থ ব্যয় করছি, তখন তা পৃথিবীর অন্য প্রান্তে আমার মুসলিম ভাইদের রক্তপাতের কারণ হচ্ছে! তাই বলছি, যখন আমি দাওয়াহ দিয়ে আমার পরিচিত একজন মানুষকেও শিরক থেকে বিরত রাখতে পারব, তখন আমি কোথাও না কোথাও আমার মুসলিম ভাইয়ের অপমান ঠেকাতে পারব। আমাদের উপর যা কিছু আযাব, তা যে মূলত আমাদের পাপেরই ফল, তাতো আল্লাহ কুরআনেই বলে দিয়েছেন, তাই না? তবে কিভাবে এগুলো হচ্ছে, তার সমীকরণ সবসময় সরল বা বোধগম্য নয়। কেন? কারণটা শুরুতেই বলে নিয়েছি, আমাদের ইন্দ্রিয়ের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা!

তবে হ্যাঁ, একটা কথা-জান্নাতে যাওয়ার পথ কিন্তু কখনই মসৃণ ছিল না। আপনি চার ইমাম থেকে ইবনে তাইমিয়্যা রাহিমাহুল্লাহ--------যার জীবনীই পড়ুন না কেন আপনি দেখবেন তারা সুতীব্র অত্যাচার সহ্য করেছেন। একইভাবে, এভাবে গণহারে মুসলিম হত্যাও কিন্তু নতুন কিছু নয়। ক্রুসেডের সময় হয়েছে, হয়েছে তাতারদের দ্বারাও। তাতে কি মুসলিমরা ধ্বংস হয়েছে? কিভাবে আমাদের অনুসরণীয়রা এত অত্যাচার সহ্য করতে পেরেছিলেন? কারণ একটাই- ইন্দ্রিয়ের সীমানা পেড়িয়ে এক জগত আছে------------যেখানে আমার ক্ষুদ্রাক্ষুদ্র চেষ্টাও সাদরে গৃহীত হবে। সেই সত্ত্বার উপর আমার অবিচল আস্থা, যিনি পরম করুণাময়, জ্ঞানী ও বিচক্ষণ!  

No comments:

Post a Comment

রিবা নিয়ে জানা সিরিজের স্ক্রিপ্ট -১১

রিবার নানা রূপ আজকের পর্বে আমরা রিবার নানা রূপের সাথে পরিচিত হব যেন দৈনন্দিন জীবনে আমরা সেগুলো থেকে বেঁচে থাকতে পারি-   টাকা ধার নেয়ার...