Tuesday, July 2, 2019

নোমান আলি খানের মালয়শিয়া সফরে ভলান্টিয়ার হবার অভিজ্ঞতা -১


ভূমিকাঃ

একবার একটা লেকচারে শুনেছিলাম যে জ্ঞানকে  যদি আমরা জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ ভাবা শুরু করি তাহলে জ্ঞানের যাকাত দেয়ার ব্যাপারে আমাদের সবসময় সচেষ্ট থাকা উচিৎ, মানে যা জানছি তার অংশ বিশেষ অন্যের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করা। এই চিন্তা থেকেই নোটটা লিখতে বসা।
উস্তাদ নোমান আলী খান আমার ইসলামী পড়াশোনার জীবনে একটা বিশেষ স্থান দখল করে আছেন ঊনার তাফসীর আর অ্যারাবিক স্টাডিজের উপর লেকচারগুলোর জন্য। উনিই প্রথম উদ্বুদ্ধ করেছিলেন আরবী ভাষা শেখার জন্য। ঊনার সবচেয়ে বড় strength যেটা আমার কাছে মনে হয় যে ঊনি মনস্তত্ত্ব খুব ভালো বুঝেনতাই ঊনার কথাগুলো শুনলে মনে হয় যেন আমাকে চিনেন, তাই আমাকেই উদ্দেশ্য করে বলছেন। তাই নোমান আলী খানের মালয়শিয়া আসার খবর শুনে ভাবলাম এমন একটা অনুষ্ঠান সুন্দরভাবে আয়োজনে অংশ নেয়া উচিৎ। আলহামদুলিল্লাহ, এটা আমার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় একটা অভিজ্ঞতা। উপলব্ধিগুলো আমি ক্রমান্বয়ে তুলে ধরবঃ

পোশাকঃ

ভলান্টিয়ারদের জন্য বিশেষ পোশাক নির্ধারিত ছিল, এটা মেনে চলা আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল - মেয়েরা সম্পূর্ণ কালো, মানে জিলবাব, খিমার সবই একদম কালো হতে হবে। আর ছেলেদের পোশাক হবে পুরোই সাদা। সাথে ছিল ট্যাগ-ভলান্টিয়ার লেখা। এটার উদ্দেশ্য ছিল মূলত Identification কাদের কাছ থেকে তথ্য জানতে বা সাহায্য পেতে হবে, উপস্থিত দর্শকদের তা বুঝানো।

এই বিষয়টা থেকে আমার মাথায় একটা চিন্তা আসে।আমাদের মুসলিম মেয়েদের পর্দা করার পিছনে মূল কারণটাই কিন্তু আসলে এটা! পুলিশদের যেমন বিশেষ পোশাক থাকে, আমাদেরও তেমন পোশাকের জন্য বেঁধে দেয়া নির্দেশনা আছে। এই নির্দেশনাগুলো ঠিক ঠাক মত মেনে চললে আপনি কিরজিকিস্তান হোন আর বাংলাদেশের, আপনাকে দেখেই মানুষ বুঝবে যে আপনি একজন মুসলিম নারী! তাহলে ছেলেরা বুঝবে যে এদের সাথে বিশেষ আচরণ করতে হবে, এদেরকে পণ্যের মত treat করা যাবে না। পুলিশের চাকরি যারা করে, কিংবা আমরা যারা স্কুলে/অফিসে কোনো ড্রেস কোড মেনে নেই, তখন আমরা কিন্তু প্রশ্ন করি না যে আমি কি পরব না পরব সেটা অন্যে কেনো ঠিক করে দিবে! আমরা এসব কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মেনে নেই, কিন্তু আল্লাহরটা নেই না।! কি অদ্ভূত তাই না?আমাদের বোঝা উচিৎ যে এটা আসলে আমাদের আত্মপরিচয়ের নিদর্শন, আমাদের সম্মান। তাই IIUM এর সবখানে লেখা থাকে যে কথাটা, এটা আমার খুব ভালো লাগে-

‘‘Your Awrah is your dignity and responsibility. So observe the proper dress code’’

আন্তর্জাতিক বন্ধনঃ

মুসলিম উম্মাহ যে এক জাতি, IIUM আসলে সেটার একদম বাস্তব প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। এমন অনেক দেশের বোনরা এখানে আছে, যেসব দেশের নামও আমি আগে শুনি নাই। আমি আমার টিমে কাজ করেছি ক্যামেরুন, কিরজিকিস্তান, জর্ডান, সিঙ্গাপুর, ভারত, আফগানিস্তান, মালয়শিয়া থেকে আসা বোনদের সাথে! এদের সাথে একসাথে কাজ করতে গিয়ে দারুণ এক ঐক্যের অনুভূতি হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ।

সমমনা বোনদের মাঝে পুরোটা সময়ঃ

আমরা এখন যখন ইসলাম পালন করা শুরু করি, তখন অধিকাংশ সময়েই আজকাল  খুব একা হয়ে যাই। পরিবার, কর্মস্থল, প্রায় সব জায়গাতেই। তাই সমমনা মানুষদের সাথে একসাথে সময় কাটানো আল্লাহ্ একটা রহমত। এই রহমত উপভোগ করেছি পুরো দুই দিন পুরাটা সময়। কোনো গীবত না, অর্থহীণ না, শুধুই আল্লাহ্ সন্তুষ্টি কিভাবে অর্জন করা যায়, কিভাবে পুরো কাজটা সুন্দরভাবে করা যায়, সেটাই যখন এক দল মানুষের মুখ্য উদ্দেশ্য হয়, তখন পরিবেশটাই অন্যরকম সুন্দর হয়ে যায়। আমি ২দিনই একদম প্রবেশ পথের দায়িত্বে ছিলাম, তাই আমার কাজ ছিল মূলত অতিথিদের হাস্যমুখে, সালাম দিয়ে অভ্যর্থনা জানানো। এতবার সালাম দিয়েও ক্লান্তি লাগছিলো না একটুও, মনে পড়ছিল কুরআনের আয়াত জান্নাতের বর্ণনায় সেখানে বলা হয়েছে-

তারা তথায় অবান্তর কোন খারাপ কথা শুনবে না।কিন্তু শুনবে সালাম আর সালাম।(৫৬:২৫,২৬)

 ভালো লাগছে না এমন কাজও আল্লাহর জন্য করাঃ

সংসার, ফুল টাইম মাস্টার্স, সাথে IOU একসাথে করতে করতে Multi tasking টা (এছাড়া গত্যন্তর নেই যে কোনো!) কেমন যেন মজ্জার সাথে মিশে গেছে।তাই অলস কোথাও দাঁড়িয়ে বা বসে থাকতে হলে হাত পা নিশপিশ করতে থাকে। যেমন পরের দিন গেট খোলার আগে অনেকটা সময়, প্রায় ঘন্টা স্রেফ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে আগে চলে আসা অতিথিদের নানা প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য আর নামাযের জায়গা, অযূর জায়গা এগুলো কোন দিকে সেটা বলে দেয়ার জন্য। তো হয়ত দেখা যাচ্ছিল ১০-১৫মিনিটে একটা মাত্র প্রশ্নের উত্তর দিতে হচ্ছে। বাকিটা সময় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা! ব্যাগে Dua of the Superstar বইটা মাত্র দেশ থেকে এনে দিয়েছে এক বোন। মনে হচ্ছিল খুলে পড়া শুরু করে দেই, নতুবা মোবাইলে লেকচার শোনা শুরু করি! কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ল, এই মুহুর্তে আমার দায়িত্বটাই হল দাঁড়িয়ে থাকা আর আল্লাহ চান যে আমি আমার দায়িত্ব পালন করি। আল্লাহ্ জন্য আমরা সবসময় তাই করি না যা আমাদের করতে ভালো লাগে, বরং তাও করি যা করতে বিরক্ত লাগছে! তবে এমন সব সময়ে যিকির খুবই উপযুক্ত একটা ইবাদাত!

শৃংখলার অনুভূতিঃ

আমার গ্রুপের হেড বারবার আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল যে আমার কাজটা কত crucial কারণ আমি গেটে সবাইকে কিভাবে ম্যানেজ করছি তার উপর নির্ভর করছে পুরা হলে ভিতরে chaos হচ্ছে কি না! তাই আমরা যারা গেটে ছিলাম তারা পালা করে ওইখানেই সাথে থাকা জায়নামায বিছিয়ে নামায পড়ে ফেলেছি। কেউ কাউকে না বলে অযূ করতে যাই নাই, বা কাজ নাই দেখে নিজের অবস্থান ছেড়ে এক চুলও নড়ি নাই। এই যে সুশৃংঙ্খলভাবে সব কিছু করা, দলবদ্ধভাবে এটা অনেক বড় একটা শিক্ষা আসলে। আমার মনে পড়ছিল উহুদের যুদ্দের কথা যেখানে সামান্য একটা কথা না শোনায় কত বড় মূল্য চুকাতে হয়েছিল। এই দুটো কোনোভাবেই তুলনীয় না যদিও, তবুও এই উপলব্ধিগুলো সত্যি মূল্যবান!

মালয়শিয়ানদের হৃদ্যতাঃ

আমি মালয়শিয়া ছেড়ে যাওয়ার সময় যে বিষয়গুলো খুব মিস করব, তার মাঝে একটা হচ্ছে এখানকার মানুষের হাস্যমুখিতা। আপনি চিনেন না জানেন না, মানুষ আপনাকে দেখে মিষ্টি করে হেসে সালাম দিবে। ঊনাদের এই স্বভাবের জন্যই গেটে ভলান্টিয়ারিং এর কাজটা সহজ হয়েছিল। যদি কারো এন্ট্রি টিকেট ভিতরে অন্যের কাছে থাকে, নির্দেশ ছিল তাকে ঢুকতে দেয়া হবে না, যার কাছে আছে, সে বের হয়ে এসে, টিকেট দেখিয়ে নিয়ে যাবে। যত জনকে এভাবে গেটে দাঁড় করিয়ে রেখেছি, প্রত্যেককে স্যরি বলেছি, কিন্তু তারা বারবার হেসে বলেছেন যে ব্যাপার না, তারা বুঝতে পারছেন কেন এমন করা হচ্ছে। এত Understanding crowd………মাশাআল্লাহ। May Allah reward them for their easiness.

এই ছিল মোটামুটি পুরো অভিজ্ঞতাতে আমার নিজস্ব উপলব্ধি। উস্তাদের কাছ থেকে যেসব মিলিয়ন ডলার জ্ঞান অর্জন করেছি, সেটা পরের পর্বে তুলে ধরছি।  

২য় পর্বের লিংক 



No comments:

Post a Comment

রিবা নিয়ে জানা সিরিজের স্ক্রিপ্ট -১১

রিবার নানা রূপ আজকের পর্বে আমরা রিবার নানা রূপের সাথে পরিচিত হব যেন দৈনন্দিন জীবনে আমরা সেগুলো থেকে বেঁচে থাকতে পারি-   টাকা ধার নেয়ার...