Wednesday, July 3, 2019

‘দুনিয়াবী পড়াশোনা'কে ইবাদাতে পরিণত করা -৩

২য় পর্বের লিংক


আজকের পর্বে আমি একদম সুনির্দিষ্ট করে পয়েন্ট আকারে বলতে থাকবো যে আইন বিষয়ে পড়ে একজন মেয়ে কিভাবে বৃহত্তর পরিসরে অবদান রাখতে পারে। এখানে আবারো বলে রাখা ভালো যে এটা আমার উর্বর মস্তিষ্কজাত চিন্তা, অনেক ডিসিপ্লিন নিয়েই আমার এরকম নিজস্ব চিন্তা আছে।
আইন পেশা ছেলে ও মেয়েদের উভয়ের জন্য দারুণ একটা পেশা যার মাধ্যমে বৃহত্তর পরিসরে অবদান রাখার বিশাল সুযোগ আছে। একটি রাষ্ট্রের জন্য ন্যায্য বিচার ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা বলে বুঝানোর কিছু নেই। একটি জাতিকে ধ্বংসের জন্য আইন ও শিক্ষা ব্যবস্থা নষ্ট করে দেয়াই যথেষ্ট- খুব সম্ভবত এটা লর্ড ক্লাইভের একটা উক্তি। তাই একজন মুসলিম একজন সৎ ও নিরপেক্ষ আইনজীবি, বিচারক হওয়ার চেষ্টা করতে পারে।

এত গেল একটা আদর্শ পরিস্থিতি। বর্তমান বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। আমরা যেহেতু এখন মানব রচিত আইন ব্যবস্থার মাঝে বাস করছি তাই ইসলামপন্থীরা নানা ধরণের জুলুমের শিকার। প্রচলিত আইন ব্যবস্থার মাঝেই যতটুকু সম্ভব তাদেরকে ন্যায় বিচার দেয়াটা যেন সম্ভব হয় (অন্যায়ভাবে গ্রেফতার হলে ইত্যাদি) সেজন্য আমাদের প্রচুর প্র্যাক্টিসিং আইনজীবী দরকার যারা প্রচলিত সিস্টেমের ব্যাপারে খুবই দক্ষ।

কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে বর্তমানে কোর্টের যে পরিবেশ তা একজন প্র্যাক্টিসিং মুসলিম মেয়ের জন্য মারাত্মক বৈরী। কিন্তু তা হলে কি একটা মেয়ে আইন নিয়ে পড়বে না?

আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি পড়বে, পড়া উচিৎ। আসুন দেখা যাক কিভাবে সে এই বিষয় নিয়ে পড়ে অবদান রাখতে পারে।

প্রথমত, যখন একটা মেয়ে ‘আইন’ একটা শাস্ত্র হিসেবে পড়বে তখন সে শরীয়াহ আইন গুলোকে একটা অন্য আলোয় দেখার সুযোগ পাবে। আমরা খেয়াল করলে দেখবো যে ইসলাম নিয়ে যত আক্রমণ, বিতর্ক হয় সেগুলোর অধিকাংশেরই উৎস হচ্ছে শরীয়াহ আইন।

একটা খুব কমন উদাহরণ হচ্ছে- হিল্লা বিয়ের আইনটা। ছোট বেলায় দেখা নাটক সিনেমার একটা কমন দৃশ্য ছিলো যে স্বামী এসে ভাত চেয়েছে, বউ বলেছে ভাত হয় নাই, স্বামী রেগে গিয়ে যাহ তোরে আমি তালাক্ব দিলাম বলে তিন তালাক্ব দিয়ে দিলো। আর মেয়েটা আল্লাগো বলে একটা চিল্লান দিলো। তারপর তাদের হিল্লা বিয়ে হল ইত্যাদি নানা কিছু। আসলে কি তালাক্বের ব্যাপারটা এমন? IOU তে Fiqh of Marriage কোর্সে যখন বিয়ে এবং তালাক্বের নিয়ম বিস্তারিত পড়েছিলাম, আমার এত অবাক হয়েছিলাম যে বলার মত না! নিয়মটা কী, আর আমরা জানিটা কী!

এতো গেলো জাস্ট একটা উদাহরণ। আরো শত সহস্র দেয়া যায়। যেমন এটা খুব কমন কথা যে ইসলামে চোরের শাস্তি হাত কাটা। এটাকে বর্বর প্রথা হিসেবে আখ্যায়িত করে ইসলামকে পশ্চাৎপদ হিসেবে তুলে ধরা হয়। আমার মনে আছে যে হুমায়ুন আজাদের পাক সার জমিন সাদ বাদ বইটাতে কোনো বাচ্চা ছেলে গাছের নিচে পরে থাকা ফল না বলে কুড়িয়ে নিয়েছিল বলে তার হাত কেটে দেয়া হয়েছিল এমন কিছু ছিলো। কিন্তু ব্যাপারটা কি আসলে তাই?

আমাদের বিবিএ সিলেবাসে Business law একটা কোর্স ছিলো। সেখানে আমার প্রথম ‘আইন’ বিষয়টার সাথে পরিচয় হয়। তখন আমি সেখানে পড়েছিলাম যে কখনই কোনো একটা বিষয়ে ‘আইন বা শাস্তি অমুক’ এভাবে এক কথায় বলা যায় না। বিশেষ করে ‘ক্রিমিন্যাল ল’ এর ক্ষেত্রে। বিষয়টা জটিল এবং সূক্ষ্ম। যে কোনো কাজের শাস্তি অমুক সেটা বলার আগে কোন প্রেক্ষিতে, কোন শর্ত পূরণ সাপেক্ষে এটার প্রয়োগ করা যাবে আর কখন যাবে না এরকম বহু কিছু বলা থাকে। ঠিক এই ব্যাপারটা ইসলামী আইনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। পরে যখন IOU তে ইসলামী আইন ব্যবস্থার উপর কোর্স করেছি তখন এই হাত কাটার শাস্তি প্রয়োগের শর্ত, পরিস্থিতি এরকম সব কিছু বিস্তারিত পড়েছি। যেমন একটা শর্ত হচ্ছে যে চুরিকৃত মালটার মূল্য ন্যুনতম চল্লিশ দিরহামের সমমানের হতে হবে। তাহলে এখন আপনারাই বলেন গাছের তলায় কুড়িয়ে পাওয়া ফলের ক্ষেত্রে এই শাস্তি প্রযোজ্য হবে?

পরবর্তীতে আমি ইসলামী শাস্তি আইন নামে একটা বই পড়েছিলাম (কেউ আগ্রহী হলে এই লিংকে গিয়ে পড়তে পারেন http://www.islameralobd.com/2015/11/book-islamic-law.html যেখানে ইসলামের শাস্তি আইনের ব্যাপারগুলো অসাধারণ নৈপুণ্যের সাথে তুলে ধরা হয়েছিলো। বলাই বাহুল্য বইয়ের লেখক একজন আইনের অধ্যাপক।

তাই আমার কাছে মনে হয়েছে আমাদের এমন দক্ষ মানব সম্পদ দরকার যারা প্রচলিত আইন নিয়ে গভীরভাবে জানবে, সাথে শরীয়াহ আইন নিয়ে জানবে। তারপর ইসলামের তথাকথিত বিতর্কিত শরীয়াহ আইনগুলোর প্রজ্ঞা সাধারণ জনগণের কাছে সহজ ভাষায় তুলে ধরবে প্রচলিত আইনের সাথে তুলনার মাধ্যমে।

কেউ যদি এমনিতে শুধু শরীয়াহ নিয়ে পড়ে তাহলে তার অ্যাপ্রোচ, আর যে প্রচলিত আইন নিয়ে পড়েছে, তারপর শরীয়াহ আইন নিয়ে পড়েছে তার অ্যাপ্রোচ স্বাভাবিকভাবেই আলাদা হবে। ২য় গ্রুপের অ্যাপ্রোচ তুলনামূলকভাবে বেশী Effective হবে বলে আমার কাছে মনে হয়। (আল্লাহই ভালো জানেন)।

দ্বিতীয়ত, বেশ কিছু ব্যাপারে ইসলামী আইনের প্রজ্ঞা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। তাই কেন ইসলামী আইন কোনো একটা কিছুর বিধান দিয়েছে সেটা প্রচলিত আইনের সাথে তুলনা করে ইসলামী আইনের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরা যায়। যেমন ধরুন মৃত্যু দণ্ড প্রথাটা বর্বর মনে করে অনেক দেশই এখন এটাকে নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু কার্যকারিতার দিক থেকে চিন্তা করলে এবং অর্থনৈতিকভাবে দীর্ঘমেয়াদে চিন্তা করলে মৃত্যু দণ্ড বেশী কার্যকরী পন্থা। আমার ইউনিভার্সিটির ইকোনোমেট্রিক্স এর প্রফেসরের রিসার্চ পেপার আছে ২টা এটার উপর। মজার ব্যাপার হচ্ছে এটা নিয়ে পেপার নাই বললেই চলে। মুসলিমদের তো প্রশ্নই উঠে না, নন-মুসলিমদের মাঝেও নাই। একজন মুসলিম এধরণের কাজ করতে পারে।

তৃতীয়ত, ‘ল’ ফিল্ডটার ক্রম বিকাশ/ বিবর্তন নিয়ে কাজ করতে পারেন কেউ। দেখাতে পারেন যে আজকে যত মানব রচিত আইন আছে সেটার উৎস কোনো না কোনোভাবে কোনো ধর্মীয় গ্রন্থের (যেমন বাইবেলের 10 commandments) সাথে সম্পর্কিত। তাই আজকে ধর্মের প্রয়োজনীয়তা যতই অস্বীকার করা হোক না কেন, মানুষের পক্ষে একদম শূন্য থেকে শুরু করা আসলে সম্ভব না।

আরো দেখানো যেতে পারে যে ‘আইন’ করে সমাজের সব বিপর্যয় প্রতিরোধ করা যায় না, নৈতিকতার প্রসার অপরিহার্য আর সেটা ধর্মীয় প্রভাব ছাড়া সম্ভব না।

(চলবে)

৪র্থ পর্বের লিংক










No comments:

Post a Comment

রিবা নিয়ে জানা সিরিজের স্ক্রিপ্ট -১১

রিবার নানা রূপ আজকের পর্বে আমরা রিবার নানা রূপের সাথে পরিচিত হব যেন দৈনন্দিন জীবনে আমরা সেগুলো থেকে বেঁচে থাকতে পারি-   টাকা ধার নেয়ার...