আজকের পর্বে আমরা আরো কিছু
সম্ভাব্য উপকারিতার কথা উল্লেখ করবো ইনশাল্লাহ।
চতুর্থত, যে ল ফিল্ডটা নিয়ে পড়েছে সে খুব ভালো
বুঝবে ফতওয়া এবং শরীয়াহর মাঝে পার্থক্য। আমার ইদানিং মনে হয় প্র্যাক্টিসিং
মুসলিমদের মাঝে মহামারীর মত ছড়িয়ে যাওয়া একটা সমস্যা হল ফতওয়া এবং শরীয়াহর মাঝে
পার্থক্য বুঝতে না পারা। ফতওয়া By definition একটা নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে,
নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট জায়গায় নির্দিষ্ট একজন মানুষকে দেয়া স্কলারের মতামত।
এখন একজনকে দেয়া ফতওয়া আরেকজনের উপকারে লাগতে পারে ঠিকই, ঠিক যেমন আগে কোনো এক
সময়ে কোনো কোর্টে দেয়া রায় পরবর্তীতে বিচার করার সময় আইনের একটা উৎস হতে পারে।
কিন্তু সেটার সাথে তুলনা করে আজকে রায় দেয়ার সময় অবশ্যই সময়, পরিস্থিতির পরিবর্তন,
সাথে আগের কেসের সাথে এই কেসের পার্থক্য বিবেচনা করতে হয়।একইভাবে একটি ফতওয়া
আরেকজন মানুষের জন্য প্রযোজ্য হবে নাকি সেটা বুঝতে হলে চেক করতে হবে দুজন মানুষের পরিস্থিতি,
সময়, দেশ ইত্যাদি একই নাকি। এগুলো চিন্তা না করেই আমরা একটা ফতোয়ার ওয়েবসাইট থেকে
ফতওয়া কোট করে দিয়ে দেই। আমি নিজে Islam QA থেকে প্রচুর ফতওয়া উর্দ্ধৃতি দেই,
কিন্তু সেটাকে ঐশী বাণীর মর্যাদা দেই না, মানে সেটা মন দিয়ে পড়ি এবং আমি যে
পরিস্থিতিতে আছি আর প্রশ্নকর্তার পরিস্থিতির মাঝে বিশাল কোনো পার্থক্য আছে নাকি
সেটা বোঝার চেষ্টা করি। ফতওয়া শপিং করছি নাকি সেটাও খেয়াল রাখার চেষ্টা করি।
কো এডুকেশন নিয়ে Islam QA এর ফতওয়ার কথাই চিন্তা
করুন। এখানে কিন্তু ছেলে এবং মেয়ের উভয়ের জন্যই কো এডুকেশনে পড়া হারাম বলা হয়েছে,
তারপর বেশ কিছু ব্যতিক্রমও দেয়া হয়েছে। ( https://islamqa.info/en/45883 ) আমরা এই ব্যতিক্রম গুলার কথা বলিনা, আমরা এই
বিধান শুধু মেয়েদের উপর চাপিয়ে দেই এটা বলে যে ছেলেদের জন্য আয় করা ফরয। অথচ এই
ব্যতিক্রমের কথা কিন্তু ফতয়াতে বলা নাই।
আমরা যদি এই ফতওয়াটার পক্ষে দেয়া শরীয়াতের
দলীলগুলো চিন্তা করি তাহলে দেখবো এখানে Intermingling নিষেধ এমন প্রমাণগুলো
উপস্থাপন করা হয়েছে। অর্থ্যাৎ কো এডুকেশন তখনই হারাম হবে যখন সেটা ফ্রি মিক্সিং এর
কারণ হবে। এবিষয়ে আমাদের বক্তব্য আমরা শুরুতেই তুলে ধরেছি।
Intermingling এর বিপক্ষে উপস্থাপিত প্রধান
প্রমাণ সম্ভবত সেই হাদীসটি যেখানে বলা হয়েছে যে মেয়েরা ছেলেদের জন্য সবচেয়ে বড়
ফিতনা। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনো হাদীসের ব্যাপারে
আমার মনে কোনো ধরণের দ্বিধা, ক্ষোভ নাই আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু আমার প্রায়ই মনে হয়
যে এটা একটা misquoted হাদীস। কারণ মেয়েরা ঠিক কী করলে ফিতনা হয় এটার একটা সীমা
আমরা নিজেদের ইচ্ছামত ঠিক করে নিয়েছি। ইচ্ছামত বলছি কারণ কিছু ভাইকে আমি দেখি যে
বোরখার ডিজাইন নিয়ে আলোচনা করতে করতে অস্থির হয়ে যাচ্ছেন। আজকে যেখানে ইন্টারনেটে
একটা ক্লিক করলে পূর্ণাংগ নারীদেহ দেখা ও
বিশ্লেষণ করা সম্ভব সেখানে তাদের জন্য আপাদমস্তক ঢাকা মেয়েরাও ফিতনা বোরখার রঙ এর
জন্য বা বোরখার ডিজাইনের জন্য। একটা বোরখা পরা মেয়ের দিকে অনুবীক্ষণ যন্ত্র নিয়ে
না তাকালে এগুলো বোঝার কথা কী না আল্লাহই ভালো জানেন।
কিছু ভাইদের জন্য মেয়েরা ফিতনা হয়ে যান তাদের
কণ্ঠ শুনলে। আমি অবশ্যই Radio Jockey অথবা সংবাদ পাঠিকাদের কথা বলছি না কারণ
আকর্ষণীয় কণ্ঠে নন-মাহরামদের সাথে কথা না বলার নির্দেশ সরাসরি কুরআনে এসেছে। আমি
বলছি স্বাভাবিক স্বরে প্রয়োজনীয় কথার ব্যাপারে। সেটাতে কী সমস্যা আমার জানা নেই। মেয়েরা পাবলিক
প্ল্যাটফর্মে পূর্ণ পর্দা করেও (এমনকি চেহারা না দেখিয়েও বা নিক্বাব করেও) উপস্থিত
হতে পারবেন না এমন ধারণা যারা পোষণ করেন তাদের পক্ষে কী প্রমাণ আছে সেটা আমার জানা
নেই। শুধু তাই না কোনো মেয়ে কোনো বিষয়ে পাবলিকলি শিক্ষা দিচ্ছে
এই ব্যাপারটিতেও তারা আঁতকে ওঠেন। অথচ ইতিহাস সাক্ষী যে কত মুসলিম মহিলা স্কলারের কাছ থেকে কত বড় বড় আলিম
তৈরি হয়েছে।
যাই হোক, কথা বলছিলাম কো এডুকেশন নিয়ে Islam QA এর
ফতওয়া নিয়ে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এখানে কো
এডুকেশনে পড়া নিষেধ মর্মে যখন একটা ছেলেকে ফতওয়া দেয়া হচ্ছে তখন ব্যতিক্রম উল্লেখ
করা হচ্ছে, কিন্তু মেয়েদের ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে- There is no need for mixing.
Studying in this school is not essential; so long as a woman can read and write
and knows the teachings of her religion, that is sufficient, because she was
created for that, i.e., to worship Allaah. Anything beyond that is not
essential. (https://islamqa.info/en/8827 )
এটা পড়ে মনে হচ্ছে যে
ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের জন্য স্কুলে যাওয়ার কোনো দরকার নেই যদি Co-education ছাড়া
কিছু পাওয়া না যায়। অক্ষর জ্ঞানই যথেষ্ট। এই মতটা আমাদের সময়ের জন্য কতটুকু
উপযুক্ত তা আল্লাহই ভালো জানেন। তবে নিঃসন্দেহে এটা ফতওয়া যিনি দিয়েছেন তার
ব্যক্তিগত অভিমত। এখন এই সাইটে যারা ফতওয়া দেন আমি তাদের
পায়ের নখের যোগ্য নই,কিন্তু সেই সাথে এটাও সত্যি যে ইসলামে কোনো পুরোহিত তন্ত্র
নেই। তাই কোনো স্কলারের কোনো ব্যক্তিগত মত, যেটার পক্ষে ঊনি কোনো দলীল উপস্থাপন
করেন নি, সেটার সাথে দ্বিমত পোষণ করতেই পারি। এতে স্কলারদেরকে অসম্মান করা হয় না,
বরং নিজেরা জ্ঞান অর্জনের প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট না থেকে স্কলারদেরকে অন্ধ
আনুগত্যের কালচারকে নিরুৎসাহিত করা হয়।
যাই হোক, যখন একজন মেয়ে
আইন নিয়ে বিস্তারিত পড়াশোনা করবে তখন সে ফতওয়া ও শরীয়াহর মাঝে সহজেই পার্থক্য করতে
পারবে ইনশাল্লাহ। সেইসাথে একটি ফতওয়া পড়ে সে বুঝতে পারবে যে এটার কোন অংশটুকু একজন স্কলারের মত
আর কোন অংশটুকু কুরআন হাদীস থেকে সরাসরি আসছে অর্থ্যাৎ কোনো অংশটি মানতে আমরা
বাধ্য আর কোন অংশটা না।
পঞ্চমত, ‘ল’ ফিল্ডটাতে একটা খুব কমন কন্সেপ্ট
হচ্ছে letter of the law and spirit of the law এর মাঝে পার্থক্য করা। আমাদের বর্তমান সময়েও আমরা ইস্লামিস্টরা
letter of the law কে spirit of the law এর চেয়ে বেশী গুরুত্ব দেই বলে মনে হয় আমার
কাছে।
একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে মনে হয়।
একবার আমার এক পরিচিত আপুর আব্বা হঠাৎ করে মারা গেলেন কানাডার একটা শহরে যেখানে
শুধু ঊনারা স্বামী স্ত্রী থাকতেন। এখন একা বাসায় আপুর আম্মা একদমই থাকতে পারছিলেন
না, ঊনি চাচ্ছিলেন যে দেশে চলে আসবেন। তো আমি পণ্ডিত ভাবছিলাম যে এইভাবে ইদ্দতকাল
চলা অবস্থায় একা মাহরাম ছাড়া ঊনার Travel করা উচিৎ হবে নাকি। আমি এইটা নিয়ে IOU এর
ফিকহ এর একজন টিচারের সাথে কথা বললাম। উনি বললেন অবশ্যই উচিৎ হবে কারণ একজন মহিলা
একা একটা শহরে এভাবে থাকার চেয়ে Travel করে হলেও উনার দেশে মাহরামদের মাঝে থাকাটা
বেশী শরীয়াহ সম্মত কারণ সেটাই Maqasid (objective) of Shariah র বেশী কাছাকাছি- মেয়েদের একটা
নিরাপদ পরিবেশ দেয়া। তখন আমার মনে হয়েছিল যে এটা হচ্ছে letter of the law এর চেয়ে
spirit of the law কে বেশী গুরুত্ব দেয়া।
ইসলামিক ইকোনমিক্সেও এটা একটা বিশাল সমস্যা। এটা
নিয়ে আমার গত ৫ বছরের অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা থেকে আমি এটাই বুঝেছি যে আমরা আজকের
ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থাতে letter of the law কে spirit of the law এর চেয়ে বেশী
গুরুত্ব দেই। তাই হয়তো পণ্যগুলোর বাহ্যিক রূপটা শারিয়াহ সম্মত হয়েছে কিন্তু সেটা
সুদ নিষিদ্ধ করার যে উদ্দেশ্য, সেই উদ্দেশ্য সাধনে অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছে।
আমি আশা করি যে একজন আইনের শিক্ষার্থী আইন নিয়ে
তার Diversified, গভীর পড়াশোনা থেকে ইসলামী আইনের এমন প্রয়োগ নিয়ে গবেষণা করতে
পারেন ইনশাল্লাহ যেখানে প্রাধান্য পাবে Spirit of law.
আমি নিজে রিসার্চ করতে ভালোবাসি বলে নিজের
অজান্তেই হয়তো উপরের পয়েন্টগুলো সবই রিসার্চের সাথে সম্পর্কিত হয়ে গেছে। ধরুন
আপনার এমন দিকে ঝোঁক নাই। তাইলে শুধু ইসলামী আইনগুলো নিয়ে ভালোভাবে জানুন, সাথে
সেই সংশ্লিষ্ট প্রচলিত আইনগুলো। এই
আইনগুলা না জানার কারণে কত মেয়ে যে Domestic Abuse এর স্বীকার হচ্ছে আমাদের ধারণাও
নাই। আজকাল প্রচুর ডিভোর্স হচ্ছে দ্বীনী সার্কেলেও এবং কারণগুলো অনেক সময়েই সঙ্গত।
সেখানেও মেয়েদের অনেক হেল্প দরকার। মানুষের যে কী সীমাহীণ অজ্ঞতা এসব ব্যাসিক
ব্যাপারে তা মানুষের সাথে কথা না বললে বোঝা যায় না। শুধু ইসলামী আইন নিয়ে পড়লে
আপনার যে প্রজ্ঞা তৈরি হবে তা অনেকাংশে বাড়বে যদি আপনি ঠিক মত প্রচলিত আইন নিয়ে
পড়েন এবং তারপর ইসলামী আইন নিয়ে পড়েন। উত্তরাধিকার আইন নিয়ে পড়াশোনা থাকলে মানুষকে
অনেক হেল্প করা যায়......The list can go on and on. এই সাহায্য করার জন্য আপনার
পিএইচডি করতে হবে না, কোথাও চাকরি করতে হবে না......ছোট্ট বাচ্চার মা হলেও সমস্যা
নেই। সপ্তাহে কিছুটা সময় দিবেন বোনদের সাথে স্কাইপে কিংবা অনলাইনে বা বাসাতে।মূল
কথা হচ্ছে Let’s try to be people of impact. নিজে খাইলাম, ঘুমাইলাম, ক্যারিয়ার গড়লাম,
মা-বাবা হইলাম, বাড়ি করলাম, গাড়ি করলাম, নাতি নাত্নীর মুখ দেখলাম তারপর বুড়া বয়সে
হাজ্জ করলাম, দাড়ি রাখলাম, বোরখা পরলাম আর এমন বাচ্চা রেখে গেলাম যারা আমি মারা
যাওয়ার পর হুজুর ডেকে কুরআন খতম দিলো আর এতিম খাওয়ায় দিলো- এই যে একটা বৃত্ত আমরা
আমাদের চারপাশে অহরহ দেখি, সেটা থেকে আসুন বেরিয়ে আসার চেষ্টা করি,
যেভাবে পারি।
No comments:
Post a Comment