আমি যখন উচ্চশিক্ষার কথা
বলেছি তখন ইচ্ছা করেই উদাহরণ হিসেবে আইন বিষয়টিকে রেখেছি। কারণ যারা মেয়েদের কো-এডুকেশনে পড়া এককথায় হারাম
হিসেবে সাব্যস্ত করেন, তারা একমাত্র ব্যতিক্রম হিসেবে বিবেচনা করেন মেয়েদের
ডাক্তারী পড়া। তবে এক্ষেত্রেও আমি এক অদ্ভূত সাইকোলজি দেখতে পাই- দেখা যায় আমরা
নিজের মেয়েকে ডাক্তারী পড়তে দিতে চাই না কিন্তু মেয়ে বা বউ এর জন্য ঠিকই মেয়ে
ডাক্তার খুঁজি। তাদের বক্তব্য হচ্ছে সেক্যুলার বা অন্য ধর্মের মেয়েরা যদি ডাক্তার হয় তাহলেই ঊনারা
প্রয়োজনীয় সার্ভিসটা পেতে পারেন। এই যুক্তি শুনলে আমার মনে হয় যে আমরা মুসলিমরা এক
অদ্ভূত সুপারিওরিটি কমপ্লেক্সে ভুগি। আমি যা নিজের জন্য পছন্দ করি না, তা
সেক্যুলার/ নন-মুসলিম মেয়েদের জন্য চাই? আমি কি তাহলে কখনো চাই না যে তারা ইসলামের
ছায়াতলে আসুক? সবচাইতে বড় কথা আমরা কি জানি যে ইসলামিক বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেয়ার
জন্য ‘প্র্যাক্টিসিং ডাক্তারদের’ মতামত লাগে? ধরেন আপনি একজন মেয়ে, আপনি দেখাচ্ছেন
মেয়ে ডাক্তার, নন মুসলিম। এখন আপনার শারিরীক সমস্যায় আপনি রোযা রাখতে পারবেন কী না
এই সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য আপনার শুধু মুসলিম না বরং প্র্যাক্টিসিং ডাক্তারদের মতামত
লাগবে। এটা Islam QA র ফতওয়া। আমি আমার নিজের জীবনে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন
হয়েছি, আমি জানি এই সময়ে কেমন অসহায় লাগে যদি ডাক্তার মুসলিম/ দ্বীন বোঝা না হয়।
যাই হোক, ডাক্তারী পেশার ব্যাপারে এই ভিন্ন
চিন্তার কারণটা আমার কাছে পুরোপুরি পরিষ্কার না। কারণ গুনাহের দিক থেকে চিন্তা
করলে মেডিক্যাল কারণে পরপুরুষ কোনো মেয়েকে স্পর্শ করবে, তার শরীরের স্পর্শকাতর অংশ
দেখবে এর চেয়ে বহু গুণে বড় গুনাহ হচ্ছে সুদে লিপ্ত হওয়ার গুনাহ।আমার যুক্তি হচ্ছে
মেয়েদের পর্দা রক্ষার নিয়্যতে কো-এডুকেশনে হলেও মেডিক্যালে পড়া যদি জায়েজ হয়,
তাহলে মানুষকে/মেয়েদেরকে সুদের গুনাহ থেকে বাঁচানোর জন্য একজন মেয়ের অর্থনীতিতে
পড়া জায়েজ হবে না কেন?
হয়তো বা পাল্টা যুক্তি আসবে যে মেয়েদের যেহেতু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকার
দরকার নাই, তাই ওদের এব্যাপারে জানা অর্থহীণ। ছেলেরা পড়বে এবং ছেলেরা ছেলেদের কাছ
থেকে জানবে। আমি বিনয়ের সাথে এই যুক্তির সাথে দ্বিমত পোষণ করি কারণ সেটা বর্তমান
বাস্তবতাকে তুলে ধরে না। সুদের ব্যাপারে মেয়েদের অজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েই ক্ষুদ্র ঋণ
প্রকল্পের মাধ্যমে সুদ ভিত্তিক সিস্টেম আমাদের দেশের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। তাছাড়া
প্রতিটা ছেলে মাত্রই জানে যে তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পেছনে চালিকা শক্তি
হিসেবে কাজ করে মেয়েরা। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে যদি ঠিকমত, সহজ ভাষায় এই সুদ
ভিত্তিক সিস্টেমের রক্তচোষা রুপটা মেয়েদের কাছে বুঝানো যায় তাহলে ইসলামের বুঝ
থাকুক বা না থাকুক, অধিকাংশ মেয়ে এটাকে তীব্রভাবে ঘৃণা করতে শিখবে। তাদের ঘৃণা
ছেলেদের সুদভিত্তিক লেনদেন থেকে বিরত থাকার পথে এক বিশাল প্রেরণা হবে
ইনশাল্লাহ।কল্পনা করুন একটি প্রজন্মের যেখানে মেয়েরা সুদী ব্যাংকে চাকরী করা
ছেলেদের বিয়ের জন্য গণহারে প্রত্যাখ্যান করছে, ছেলের আয়ে যদি সুদ থাকে তাহলে
মায়েরা তাঁকে দেয়া উপহার ফিরিয়ে দিচ্ছে, মেয়েরা বাবাকে ক্রমাগত বলছে বাবা সুদ থেকে
ফিরে আসো। আমাদের মা, বোন, স্ত্রীরা যদি সুদ কোনটা সেটাই না চিনে, তাহলে কিভাবে
তারা এই সামাজিক বিপ্লবটা ঘটাবে?
কিংবা ধরুণ আপনি চরম মাত্রায় প্রসব
পরবর্তী ডিপ্রেশনে ভুগছেন। তখন কার কাছে যাবেন? পুরুষ কাউন্সেলরের কাছে? সে কি
কোনোদিনও এই অভিজ্ঞতার মাঝ দিয়ে গেছেন? চিকিৎসার মনস্তাত্বিক দিকটা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। একজন নারী
কাউন্সেলর যদি আপনার হাত ধরে মোলায়েম স্বরে বলে আমি নিজে জানি এই সময়টা কী তীব্র
কষ্টের তখন রোগীর সুস্থ হয়ে ওঠা যে কতটা ত্বরান্বিত হবে তা কি আমরা বুঝি?
সেক্যুলার নারী কাউন্সেলরদের দিয়েও কি এই সার্ভিস পাওয়া সম্ভব? সে আপনাকে কোনোদিনও
বলবে যে মন খুব খারাপ থাকলে একটু কুরআন শুইনেন? নাকি রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনতে বলবে?
প্রত্যেকটা
ফিল্ডের ব্যাপারে আসলে এমন উদাহরণ দেয়া যায়। সাইক্যোলজি, এডুকেশন,
মার্কেটিং, ডাটা সাইন্স, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি ইত্যাদি। ইসলামের একটা
সৌন্দর্য্য হচ্ছে যে মোটামুটি সব ফিল্ডের জ্ঞানকেই ইবাদাতে পরিণত করার সুযোগ আছে।
একটা উদাহরণ দেই। সাহাবীদের উপরে একটা লেকচার সিরিজে শুনছিলাম যে আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তৎকালীন আরবদের মাঝে
সবচেয়ে বড় genealogist ছিলেন। Genealogy is the study of lineage. বংশ নিয়ে, সোজা
বাংলায় চৌদ্দ গুষ্টি নিয়ে পড়াশোনা। বক্তা সেখানে বলছিলেন যে এই সাব্জেক্টটা
সেক্যুলার এবং ইসলামিক দুই ক্ষেত্রেই একটা মিসিং ব্রাঞ্চ এখন। শুনে আমি একটু অবাক
হইসিলাম। ইসলামিক এত শাখা থাকতে Genealogy নিয়ে পড়ার কি দরকার? আমাদেরতো এখন
আরবদের মত এত গোত্রীয় সমাজ ব্যবস্থা না যে গোত্রের ইতিহাস দাওয়াতী কাজে লাগবে।
২দিনের মাঝেই উত্তর পেলাম একটা ফেসবুক পোস্ট থেকে যাতে মুহাম্মাদ আসাদ (বিখ্যাত
Road to Mecca বইটার লেখক) এর সাথে Dr Chaim Weizmann (ইসরাঈল রাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট) এর একটা কথোপকথন
তুলে ধরা হয়েছে। মুহাম্মাদ আসাদ সেখানে প্যালেস্টাইনের উপর ইহুদীদের অধিকারের
হাস্যকর যুক্তি খণ্ডন করেছেন ইহুদীদের বংশ লতিকার উপর জ্ঞান দিয়ে।
চিন্তা করুন, Genealogy র মত একটা বিষয়কে আজকের
সময়ে ইসলামের খেদমতে কাজে লাগানো সম্ভব। তাহলে আগে যেগুলোর কথা উল্লেখ করলাম
সেগুলো কত দারুণ ভাবে সম্ভব! সত্যি কথা বলতে কী দুনিয়াবী শিক্ষার সংজ্ঞাই আমার কাছে ক্লিয়ার না।
আমার এই সিরিজে আমি এই ব্যাপারটাই বুঝানোর চেষ্টা করেছি যে দ্বীন শিক্ষা আর
দুনিয়াবী শিক্ষা Mutually exclusive না। দুনিয়াবী শিক্ষা অর্জনকেও ইবাদাতে পরিণত
করা সম্ভব। তবে আমি অবশ্যই সবাইকে পিএইচডি/ রিসার্চ করতে বলছি না, রান্না করা,
ঘরের কাজকে আমি ছোট করেও দেখছি না। আমি শুধু Diffusion of responsibility র
কন্সেপ্টটার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছি। এটার মানে হচ্ছে যে আপনার সামনে একটা
ছিনতাই বা কোনো অপরাধ হচ্ছে আপনি ভাবছেন আরেকজন এগিয়ে যাবে। সমস্যাটা হয় যখন সবাই
ভাবতে থাকে যে আরেকজন এগিয়ে যাবে। এটাই হচ্ছে Diffusion of responsibility। যখন
মেয়ে ডাক্তার, সাইক্যোলজিস্ট, ইকোনোমিস্ট এগুলাকে Communal responsibility ভাবেন,
মানে এসব সার্ভিস কারো না কারো কাছ থেকে চান, কিন্তু এই জীবনটা অনেক চ্যালেঞ্জিং
বলে নিজের বা নিজের মেয়ে/ স্ত্রীর জন্য বেছে নেন না, তখন একটা প্রজন্মের মাঝে আপনি
দেখবেন এই সার্ভিস দেয়ার কেউ থাকছে না, কারণ সবাই আপনার মত করে ভাবছে।
তাই আসুন আমরা আমাদের টার্গেটের লেভেলটা একটু
বাড়াই। আমরা আসলে জানিনা কার মাঝে কী আগুন লুকিয়ে আছে, আমরা জানি না কার সম্ভাবনা
কতটুকু। আজকে যেমন আমরা কল্পনাও করতে পারি না যে আমাদের বাচ্চারা ক্লাস ফাইভ
পর্যন্ত পড়বে, সেরকম আসুন আমরা এমন একটা সময় গড়ার টার্গেট করি যেখানে এটা অসম্ভব
ব্যাপার হবে যে কারও শুধু ১০টা সূরা মুখস্থ। আমরা যদি পারস্পরিক প্রতিযোগিতার
মাধ্যমে ইসলামের ব্যাসিক জ্ঞান, হিফয, প্যারেন্টিং, ইকোনমিক্স, ল, সাইকোলজি এসব
Applied ফিল্ড এর জ্ঞান নিয়ে নিজেদের মাঝে লেভেলটা বাড়াই তাহলে আমরা খুব দ্রুত
একটা বিশাল পরিবর্তন দেখতে পাবো ইনশাল্লাহ। সবাই যেন আমরা একই কাজ না করি, একজন
আরেকজনের দক্ষতা থেকে উপকৃত হই।
No comments:
Post a Comment