Wednesday, July 3, 2019

‘দুনিয়াবী পড়াশোনা'কে ইবাদাতে পরিণত করা -শেষ পর্ব


৫ম পর্বের লিংক

শেষ কথাঃ

এই যে এতক্ষণ ধরে যা আলোচনা করলাম এই সব কিছুই অর্থহীণ প্রলাপ হিসেবে সাব্যস্ত হবে যদি আপনি মেয়েমানুষের এত পড়াশোনার দরকার কী এই তত্ত্বে বিশাসী হন। আমি অনেক প্র্যাক্টিসিং ভাইদের মাঝেই এহেন চিন্তাভাবনা দেখি। ইসলামের বুঝ আসার পরও তারা যদি মেয়েদেরকে 2nd class citizen ভাবেন তবে সেটা দুঃখজনক। আমি বিশ্বাস করি ছেলে ও মেয়ে উভয়কেই আল্লাহ প্রাথমিকভাবে একই কারণে সৃষ্টি করেছেন-তার ইবাদাতের জন্য। তাই কোনো মেয়ে যদি শরীয়াতের দেয়া সীমারেখা মেনে চলে বৃহত্তর পরিসরে কিছু করতে চান, আল্লাহ অবশ্যই সেটার মূল্যায়ন করবেন ইনশাল্লাহ। এজন্য নিচের আয়াতটা আমার খুব প্রিয়-

অতঃপর তাদের পালনকর্তা তাদের দোয়া (এই বলে) কবুল করে নিলেন যে, আমি তোমাদের কোন পরিশ্রমকারীর পরিশ্রমই বিনষ্ট করি না, তা সে পুরুষ হোক কিংবা স্ত্রীলোক। (৩:১৯৫)

যারা মেয়েদের উচ্চশিক্ষার বিরোধিতা করেন, তারা মূলত এই কথাটাই বলে থাকেন-এতে পরিবারের হাক্ব নষ্ট হয়। আমি অস্বীকার করবো না যে এমন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তবে সেক্ষেত্রে আমি মনে করি যে পরিবারের বাকি সদস্যদেরও এ ব্যাপারে সহানুভূতিশীল হওয়া উচিৎ। আমার সীমিত অভিজ্ঞতা বলে যে আজকালকার প্র্যাক্টিসিং ছেলেরা যখন ঘরে থাকা মেয়ে স্ত্রী হিসেবে অগ্রাধিকার দেন তখন নিজের অজান্তেই এমন মেয়ে চান যে ঘর বাড়ি পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখবে আর নানা রকম মজার মজার রান্না করবে। এগুলো নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় কাজ। কিন্তু আমরা যেন ভুলে না যাই যে আমরা সেই নবীর উম্মাত যার ঘরে মাস পার হয়ে যেত চুলা জ্বলতো না। ঊনার ঘরে প্রয়োজনীয় জিনিসটাও ছিল না। আমাদের ঘর যদি তেমন হত, তাহলে তো গুছানোর, পরিষ্কার করারই এত কিছু থাকতো না! সেই সাথে আমরা যেন নিচের হাদীসটাও একদমই উপেক্ষা না করে ফেলি-

“The human does not fill any container that is worse than his stomach. It is sufficient for the son of Adam to eat what will support his back. If this is not possible, then a third for food, a third for drink, and a third for his breath.” [Jami at-Tirmidhi]

মেয়েদের উচ্চশিক্ষা নিয়ে কথা বলতে গেলে আমাদের  আরো মাথায় রাখতে হবে যে একই প্রেস্ক্রিপশন সবার জন্য প্রয়োগ করা যাবে না। কিছু মেয়ে থাকবে, ছিলো, যাদের জীবনটা আমাদের তৈরি করা ছকে ফেলা যাবে না। দুঃখজনক হচ্ছে আমরা ইস্লামিস্টরা একটা মেয়ের জীবনের যে ছবি আঁকি তাতে সব মেয়ের একদম ঠিক বয়সে বিয়ে হয়, বাচ্চা হয় এবং তাদের একজন আদর্শ স্বামী আছে যারা যথেষ্ট ইনকাম করে আর বউ ঘরে থাকে বলে বিগলিত হয়ে তাকে সম্মান করে। এই চিত্র যে কতটা অবাস্তব তা একটু চারপাশে খোলা চোখ নিয়ে তাকালেই আমরা টের পাবো ইনশাল্লাহ।  আমার এক ফ্রেণ্ড একবার আমাকে বলেছিলো যে সে ইসলামে নারীদের রোল নিয়ে লেখাগুলো সে পড়া বন্ধ করে দিয়েছে কারণ সে কারো স্ত্রী না এবং কারো মা না। তাই ওই লেখাগুলোতে ওর জন্য কোনো নির্দেশনা নেই। কথাটা শুনে আমি কেন যেন খুব লজ্জা পেয়েছিলাম। আমরা সমাজ থেকে কতটা বিচ্ছিন্ন যে ভুরি ভুরি অবিবাহিত, মা না হতে পারা, ডিভোর্সড মেয়েরা আমাদের সমীকরণের মাঝেই নাই!। ইসলামে নারীর রোল শুধু মা বা স্ত্রী হতে পারার মাঝেই সীমাবদ্ধ-আমাদের এই পরোক্ষ প্রচারণার জন্যই আমরা সম্ভবত একটা বিশাল গ্রুপ তৈরি করেছি যারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন একজন প্রিন্স চার্মিং এর জন্য যে তার সমস্ত সমস্যার সমাধান করে দিবে। ইন ফ্যাক্ট আমি একাধিক মেয়ের কাছে শুনেছি যে তারা অপেক্ষা করছে তাদের বিয়ে হবে, তারপর জামাই এর টাকায় তারা দ্বীন শিক্ষা করবে। নিঃসন্দেহে এটা এক ধরণের পরজীবী মানসিকতা এবং যদি এমন স্বামী তাদের তাক্বদীরে না থাকে তাহলে তাদের মনে হবে জীবনটা ষোল আনাই মিছে। আমার মনে হয় এভাবে আমরা দারুণ মেধাবী কিছু মেয়েকে চরম অপদার্থ বানিয়ে ফেলছি। যাদের এখনো বিয়ে হয়নি, মায়ের সংসারে কোনো দায়িত্ব নেই, বাচ্চা হয় নাই, ডিভোর্সড এইসব মেয়েরা কিছু করছে না কারণ তারা কো এডুকেশনকে unconditionally হারাম ভাবছে।

আমি আবারো বলছি আমরা যদি আমাদের কাজগুলোকে ইবাদাতে পরিণত করতে চাই তাহলে আমাদেরকে অবশ্যই নিয়্যতের পরিশুদ্ধতার ব্যাপারে সবচেয়ে সতর্ক থাকতে হবে, সমাজের লোক কী বললো না বললো সেটাকে অগ্রাহ্য করতে জানতে হবে।

নিয়্যত পরিশুদ্ধ রাখার একটা উপায় হতে পারে অ্যাকাডেমিক বিষয় অধ্যয়নের সাথে সাথে কুরআন/হাদীস/ তাফসীর/ ফিকহ ইত্যাদির ফরয জ্ঞানটুকু আদায় করা। কোন লেভেলের জ্ঞানটুকু ফরয সেটা ভিন্ন আলোচনা, এখন শুধু এটুকু বলতে চাই যে আমার অভিজ্ঞতা অনুযায়ী Islamic Online University এর ইসলামিক স্টাডিজে ব্যাচেলর প্রোগ্রামে যা পড়ানো হয় সেটা আদতে ফরয লেভেলের জ্ঞান, ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স করছি এই মর্মে আত্মতৃপ্তিতে ভুগার সুযোগ কম

এই ফরয লেভেলের জ্ঞান অর্জন আর অ্যাকাডেমিক যে বিষয়ে পড়ছিলাম সেটাতে এক্সিলেন্সি অর্জন-২টা একসাথে চালানো কি সম্ভব? আমার নিজের এবং চারপাশের অনেককে দেখে বুঝেছি যে এটা সম্ভব, দরকার শুধু প্রচণ্ড Determination আর Proper Time Management, সাথে আল্লাহর কাছে অহর্নিশ সাহায্যের জন্য দুআ করে যাওয়া।

আমার একটা খুব প্রিয় দুআ হচ্ছে-

O my Lord, choose me to serve your deen.

এটা খুব গভীর একটা দুআ। কারণ আল্লাহর দ্বীন বিজয়ী হবেই। সেই প্রক্রিয়ায় দর্শক না হয়ে সৈনিক হতে পারাটা একটা বিশাল সৌভাগ্য। আল্লাহর কাছে আকুল ভাবে না চাইলে আল্লাহ এটা যাকে তাকে দেবেন না।

তাই ওরে বাবা আমি ফিতনায় পরে যাবো এটা ভেবে জ্ঞান অর্জনের ও সেই জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে উম্মাহর জন্য বড় কিছু করার স্বপ্ন বিসর্জন দিবেন না। আস্থা রাখুন আল্লাহর সাহায্যের উপর। সেই সাথে খেয়াল করতে হবে যে বৃহৎ পরিসরে উম্মাহর জন্য কাজ করতে গিয়ে আমরা আমাদের প্রাথমিক দায়িত্বে তথা পরিবারের প্রতি দায়িত্বে যেন অবহেলা না করে বসি।

আমার বক্তব্য এখানেই শেষ। আমি বারবার বলছি এই লেখা সেইসব মেয়েদের জন্য যাদের আল্লাহ পড়ার অনুকূল পরিবেশ দিয়েছেন, যারা কো এডুকেশনের ফিতনা এড়ানোর ক্ষমতা রাখেন, তবুও এটাকে unconditionally হারাম ভেবে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। তাদের প্রতি আমার অনুরোধ, আল্লাহর সাথে নিয়মিত কথা বলার অভ্যাস করুন, তাহাজ্জুদের জন্য উঠুন। নিজের Strength এবং weakness এর একটা লিস্ট করুন, বর্তমানে যা করছেন, কেন করছেন সেটা লিখে ফেলুন, সর্বোপরি আল্লাহর কাছে সাহায্য চান। আকুল হয়ে দুআ করুন, আল্লাহর পথে সৈনিক হতে চাওয়ার আন্তরিক দুআ আল্লাহ ফিরিয়ে দিবেন না ইনশাল্লাহ।

যা কিছু বলেছি তাতে যদি ভালো কিছু থেকে থাকে তবে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে, আর যদি ভুল কিছু বলে থাকি তাহলে তা আমার নফসের এবং শয়তানের কুমন্ত্রণা। আল্লাহ আমাদের মাফ করুন।



No comments:

Post a Comment

রিবা নিয়ে জানা সিরিজের স্ক্রিপ্ট -১১

রিবার নানা রূপ আজকের পর্বে আমরা রিবার নানা রূপের সাথে পরিচিত হব যেন দৈনন্দিন জীবনে আমরা সেগুলো থেকে বেঁচে থাকতে পারি-   টাকা ধার নেয়ার...