Tuesday, July 2, 2019

বিপ্রতীপ

(লেখাটা সিয়ান পাব্লিকেশন প্রকাশিত 'চয়ন' বইটিতে প্রকাশিত হয়েছে)


বিপ্রতীপ
.
শায়লাকে ফেসবুকের হোম পেইজ থেকে ব্লক করে দিলো নিশাত। খুবই বিরক্তিকর মেয়েটা। নিজেতথাকথিতপর্দা করে দেখে যারাই করে না তাদের ধরে ধরে 'একটা বিশেষ পেশার' মেয়েদের সাথে তুলনা করতে থাকে। সেদিন দেখি স্ট্যাটাসে লিখসে যে এসব মেয়েদের উচিৎ দোকান খোলা......কী অসম্ভব অশ্লীল কথা! খালি অশ্লীল পোশাক পড়লেই অশ্লীল হয়? মুখ খারাপ করলে অশ্লীল হয় না? বোরখা পড়লেই একটা মেয়ে ধোঁয়া তুলসি পাতা হয়ে যায়? সেদিনও তো ধানমণ্ডি লেকের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মুখ ঢাকা একটা মেয়েকে একটা ছেলের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে থাকতে দেখলো। আরো যা দেখলো সেটা বলার রুচিও হয় না নিশাতের। মুখ ওর ওই শায়লা মেয়েটার চেয়ে ভালোই আছে......এইসব মেয়েদের জন্যই হয়তো কখনো মাথায় কাপড় দেবে না নিশাত। যথেষ্ট শালীনভাবে চলে , দরকার নেই এত এক্সট্রিমিজমের।
.  
কেনো আসলি না গ্র্যাড নাইটে?
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো হুমা। একবার ভাবলো উত্তর দিবে না, এড়িয়ে যাবে। কিন্তু অপর্ণা নাছোড়বান্দা...কিরে বলছিস না যে? কেনো আসলি না?
একটা মিথ্যা অজুহাত দিতে যাচ্ছিল যে মাথা ব্যথা ছিল......মুখ খোলার আগেই অপর্ণার তীক্ষ্ম প্রশ্নটা চাবুকের মত যেন বুকের মাঝে গিয়ে বাঁধল- ‘ নাচ গান হবে বলে আসিস নি? খুব হুজুর হয়েছিস না? তোর কাছে কি মনে হয় তুই একাই ইসলাম প্র্যাকটিস করিস? আমাদের ব্যাচে তো আরো হিজাব করা মেয়ে আছে...আছে না? নিপা আসে নাইশিল্পী?

আবারো মুখ খুলতে গিয়ে থেমে গেল হুমা...একবার মনে হল বলে যে ওরা হিজাবের মর্ম বোঝে না বলে কি আমিও বুঝবো না?ওরা হিজাব পড়লে কী হবে, নামায তো পড়ে না......ওদের একজনের বাসা কড়া, তাই পড়ে, আরেকজনের বয়ফ্রেণ্ড চায়, তাই পড়ে...দেখিস, ওরা বেশিদিন ধরে রাখতে পারবে না এটা...আল্লাহর জন্য ছাড়া অন্য কারণে হলে সম্ভব না ধরে রাখা...

কিন্তু ......যে ইসলাম সর্বাংশে পালন করতে চায় হুমা, সেই ইসলামই যে ওকে এইভাবে গীবত করতে দেয় না...

হুমাকে তখনও চুপ করে থাকতে দেখে ধ্যাত বলে চলে গেল অপর্ণা।

হুমাও অনেক কষ্টে চোখের পানিটা আটকালো......মাত্র নতুন নতুন ইসলাম ক্লাসে যাচ্ছে ও। সারাজীবন ভালো রেজাল্ট, সৌন্দর্য্য সব কিছুর জন্য বন্ধু বান্ধবদের মধ্যমণি হয়ে থেকেছে, তাই  এখনো এই একা হয়ে যাওয়াটা মেনে নিতে পারে না। কষ্ট হয়, প্রচণ্ড কষ্ট। একটা হারানোর ভয় কাজ করে। সেই ভয় থেকেই কি মুখ দিয়ে মিথ্যা অজুহাত বের হয়ে এসেছিল? ভাগ্যিস মিথ্যা অজুহাত দেয় নি, আল্লাহই ওর মুখটা আটকে দিলেন যেন...

.

আমাদেরও একটা ফ্ল্যাশ মব করা দরকার কি বলিস? :D
অবশ্যই! সশব্দে টেবিলে হাত চাপড়ে বললো শিল্পী। আমি আছি সবার আগে......
তুই? একটু অবাক হয়ে বললো শোয়েব।
হ্যাঁ, কেন? গ্র্যাড নাইটে আমার নাচটা কি খারাপ ছিল? আমার প্রতিভা নিয়ে কোনো সন্দেহ আছে তোর?
না না তা থাকবে কেন? শোয়েব আড়চোখে শিল্পীর মাথার স্কার্ফের দিকে তাকালো। ওর এত উচ্ছ্বাস দেখে নিজের কাছেই অস্বস্তি লাগছে।
তুইই না বলিস যে তোর বাসা অনেক কড়া, তাই ভাবলাম...
আরে! রেকর্ডিং তো হবে ভার্সিটিতে। বাসা থেকে জানবে কিভাবে?
তাইলে আর ভার্সিটি স্কার্ফ পড়ে আসার দরকার কী?
আরে আস্তে দোস্ত আস্তে। আগেতো বোরখা পড়তাম। ভার্সিটি ওঠার পর অনেক বলে কয়ে শুধু মাথায় কাপড় দেই। সময় লাগবে না ছাড়তে?
হুম। আনমনে বলল শোয়েব।
আমি তাইলে বাকিদের ডাকি, কি বলিস? শিল্পী বলল?
হুম। যা। আমি আছি এখানেই। ইফতেখারকে পাস নাকি দ্যাখ। ভিডিও এডিটিং জোস।

অপর্ণা চুপচাপ বসে ছিল। শিল্পী উঠে যেতেই মন্তব্য ছুঁড়ে দিল...এই হচ্ছে আমাদের হিজাবীদের ইসলামের অবস্থা। হিজাবী ড্যান্সার!

একটু প্রতিবাদ করে উঠল শোয়েব। সবাই তো আর এমন না। হুমাকে দেখিস না? তো এসব করে না...

আরে রাখ! গিয়ে দ্যাখ নিপার মত ওরও নতুন কোনো অ্যাফেয়ার হইসে, বয়ফ্রেণ্ড চায় দেখে পড়া শুরু করসে।  

নিপা আরেক চিজ ওদের ব্যাচের...তাই কিছু বলতে গিয়েও শোয়েব বলল না। আসলেও তো আজকাল অ্যাফেয়ার থাকে না এমন তো হয়ই না। তবে ব্যাপারগুলো ভালো লাগে না ওর। কেন, তা জানে না যদিও। খালি মনে হয় ওদের এই কাজগুলো করা উচিৎ হচ্ছে না...

.

একটা পর্দা করা মেয়ে ইসলামের flag bearer, রাত্রি...রবীন্দ্রনাথের দাঁড়ি ছিল। ছিল কার্ল মার্ক্সেরও। একটা ছেলে দাঁড়ি রাখা মানেই যে ইসলাম প্র্যাক্টিস করা শুরু করসে এমন না। সে চে গুয়েভারার ফলোয়ারও হতে পারে। কিন্তু যে মেয়েটা বোরখা পড়ে, সে কখনো অমুসলিম হতে পারে না। অর্থ্যাৎ একটা মেয়ে জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে ইসলামকে ধারণ করছে। যদি এটার মর্যাদা রাখতে না পারিস, ছেড়ে দে......দরকার নেই পর্দা করার।

ভাবীর মুখে কথাগুলো শুনতে শুনতে চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছিল রাত্রির। এই কথা শুনে চমকে উঠল। হুমা ভাবী, তুমি এই কথা বলছো? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না...

হ্যাঁ রে। আমি বলছি। আমি চারটা বছর ভার্সিটিতে যে কষ্ট করেছি, আমি চাই না আরো কেউ সেই কষ্ট করুক।

মানে? ভেজা চোখে অস্ফূট স্বরে প্রশ্ন করল রাত্রি।

আমার - জন ক্লাসমেট ছিল ভার্সিটিতে যারা হিজাব পড়ে সব করত। সব প্রোগ্রামে নাচ গানে অংশ নেয়া, পয়লা বৈশাখে ধুমায়ে সাজ দেয়া, প্রেম করা...ওদের কাজগুলো আমার আচরণকে প্রশ্নবিদ্ধ করতো। সবাই ভাবতো আমারও নিশ্চয়ই সম্পর্ক আছে কারো সাথে। আমি জানতাম ওরা পর্দা ধরে রাখতে পারবে না। এখন যদিও আর যোগাযোগ নেই, কিন্তু ফেসবুক থেকে বুঝি যে আমার ধারণা ভুল ছিল না। ওদের মাঝে কেউ কেউ পরে সুদী ব্যাংকে জয়েন করেছে। আর সবচেয়ে মজার কথা হচ্ছে যারা আমাকে ওদের মত হতে বলতো, তারাই আবার ওদের পিছনে ওদের নিন্দা করতো!

দ্যাখ, আমি চাই না তোকে দেখে আর পাঁচটা মেয়ে প্রেম করাকে হালাল মনে করুক। কিয়ামতের দিন ওরা যদি তোকে অভিযুক্ত করে, তুই ওদের পাপের বোঝা বইবি?

এই কথাটা শুনে আমূলে কেঁপে উঠল রাত্রি। এভাবে বলো না ভাবী...আমি যে আর সইতে পারছি না। বিশ্বাস করো, আমি রিকশায় উঠতে চাই নি। দেখাও করতে চাই নি। সৈকত এত চাপাচাপি করছিল! আমরা শুধুই ফোনে কথা বলতাম। এমনিতে খুব ভালো ছেলে, বিশ্বাস করো ভাবী...

তুই কি কুরআনের আয়াত পড়িস নি? আল্লাহ কি ব্যাভিচার করতে না করেছেন, নাকি এর ধার কাছ দিয়েও যেতে না করেছেন? তুই কি জানিস না যে যিনা হতে পারে চোখের, স্পর্শের? আজকে এক রিকশায় উঠেছিস, কালকে ছুঁতে চাইবে, পরশু নিয়ে যেতে চাইবে খালি কোনো বাসায়...

আস্তাগফিরুল্লাহ ভাবী, কি বলছো এসব? সৈকত এমন কখনো করবে না...

যে ছেলে বিয়ের আগে একটা মেয়ের সাথে এমন সম্পর্কে জড়ায় সে কিভাবে ভালো হতে পারে রাত্রি?আমাকে উত্তর দে?তুই কি মানুষের চোখে ভালো সেই কথা বলছিস নাকি আল্লাহর চোখে

চুপ করে থাকল রাত্রি। প্রশ্নেরতো আসলেই কোনো উত্তর হয় না।

.

এটাতো কোনো পর্দা হল না শিল্পী! আজকে সকালেও বুয়েটে তোমাকে একভাবে দেখলাম এখন বিয়ের প্রোগ্রামেই আরেক রকম?

কথাটা শুনে মনে হল ঠাস করে কেউ চড় মারল শিল্পীকে। এভাবে কেউ কাউকে মুখের উপরে বলে? ইকবাল ওর  ছোটবেলার বন্ধু জিনিয়ার হাজব্যান্ড, তাই কিছু বলল না। ওদের আরেক বন্ধুর বিয়ে ছিল। বান্ধবীর  বিয়েতে সাজবে না তো কী! সবাই যেখানে বলতেসে দারুণ সুন্দর লাগছে, সেখানে ইকবাল এভাবে মুখের উপরে এমন একটা কথা বলে দিল?

বাসায় এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কেমন যেন অস্বস্তি লাগতে থাকলো শিল্পীর। ইকবালের কথাগুলো কানে বাজছে......এটা কেমন পর্দা হল শিল্পী? কেমন? কেমন?

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো ও। শুধু বাসায় চায় বলে যে পর্দা করে এই কথা তো নিজেই মানুষকে বলে বেড়িয়েছে। তাহলে আজকে এই কথাটা শুনে ওর এমন নিজেকে ছোট ছোট লাগছে কেন?

অনেক ক্ষণ ধরে ভাবলো শিল্পী। চিন্তা করলো যে আর যাই হোক অন্যদের মত আড়ালেতো বলেনি ছেলেটা...অনেকেই পিছনে এটা ওটা বলতো ওর কাজ কর্ম নিয়ে, টের পেত শিল্পী। কিন্তু কেউ কখনো ওকে এভাবে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়নি ওর কাজের মাঝের অসংগতি গুলো। আজকের মত এমন তীব্র কষ্টের অনুভূতি আগে কখনো হয় নি শিল্পীর......

সেই রাতে, সেই রাতে নিজের কাছেই প্রতিজ্ঞা করল শিল্পী---আর কখনো, কক্ষনো ওর হিজাবের সাথে সাংঘর্ষিক কাজ করবে না.........

**************************************************************************************************
উপরের ঘটনাগুলো আমাদের অনেকেরই জীবনের ঘটনা। আমার ধার্মিকতার প্রকাশ কেনো আমার পোশাকে ঘটতে হবে এক পুরান প্রশ্ন। কিন্তু আপনার যদি ইসলাম নিয়ে সামান্য পড়াশোনা থাকে আপনি জানবেন যে ইসলাম বাহির এবং ভেতর-উভয়ের মাঝে সামঞ্জস্য বিধান করতে বলেছে। আমরা চাই বা না চাই আমাদের আচরণ, আমাদের পোশাক অনেক কথা বলে। সাম্প্রতিক ফ্ল্যাশ মব নামক কিম্ভূত একটা বিষয়ে হিজাবী নারীদের সরব উপস্থিতি নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলছেন। সেটার প্রেক্ষিতেই এই লেখা......

একটু কি চিন্তাশীল হওয়া যায় যা করছি সেটা নিয়ে......? আমি কারো ব্যাপারে জাজমেন্টাল হতে চাই না। আমি নিজে একসময় নর্দমার মাঝে ছিলাম, আল্লাহ তাঁর খাস রহমতে আমাকে সেখান থেকে তুলে এনেছেন। আমি আশা করি আমার সেইসব বোনেরা রাত্রির মত শয়তানের কুমন্ত্রণা এড়াতে পারেন নি...শয়তান তাদের কাজকে তাদের সামনে হাল্কা শোভনীয় করে দেখিয়েছে। আমি আরো আশা করি শিল্পীদের কেউ ইকবালের মত করে ভুলগুলো ধরিয়ে দেয়নি, শুধু অপর্ণার মত আড়ালে কথা বলে শয়তানকে তার মিশনে আরো সাহায্য করে গেছে......যদি করতো, তাহলে হয়ত শিল্পীর মত আমার সেইসব বোনেরা তাদের ভুল বুঝতে পারতো।


তাই আমার সব বোন, যারা না বুঝে এই ভুল করে ফেলেছেন, তারা যেন শিল্পীর মত তওবা করে আল্লাহর কাছে ফিরে আসেন, এবং বুঝে শুনে হিজাব করেন তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণ করেন , এই দুআ করি। তাদের করা ভুল কাজ গুলো নিশাতের মত কাউকে যেন সঠিক পথ গ্রহণ থেকে বিরত না রাখে। আমীন .........


No comments:

Post a Comment

রিবা নিয়ে জানা সিরিজের স্ক্রিপ্ট -১১

রিবার নানা রূপ আজকের পর্বে আমরা রিবার নানা রূপের সাথে পরিচিত হব যেন দৈনন্দিন জীবনে আমরা সেগুলো থেকে বেঁচে থাকতে পারি-   টাকা ধার নেয়ার...