তাক্বদীরে
বিশ্বাসের স্বরূপঃ এটা কি কোনো গোলকধাঁধা?
ঘটনা ১:
আন্টিঃ আল্লাহই
তো আমার ভাগ্যে এখানে বিয়েটা রেখেছিলেন তাই না? তোর আঙ্কেলের সাথে বিয়ে হল বলেই তো
আমার দ্বীন পালনে এত কষ্ট হয়!
নিতুঃ কিন্তু
আন্টি আপনিও তো বিয়ের সময় দ্বীন পালন করে নাকি এটাকে কোনো গুরুত্ব দেন নি।
দিয়েছিলেন?
আন্টিঃ কোথায় আমার বিয়ে
হবে না হবে সেটা তো আল্লাহই লিখে রেখেছেন। আমি দেখলেই বা কি করতাম, বিয়েটাতো আর
ঠেকাতে পারতাম না, তাই না?
ঘটনা ২:
নিতুঃ
আপা, তুই যে এখনো নামায শুরু করছিস না, একবার ভেবে দেখেছিস যে এখন হুট করে যদি মরে
যাই আমরা তাইলে কি অবস্থা হবে? কিসের জন্য অপেক্ষা করছি আমরা?
আপাঃ
আল্লাহ যখন হিদায়াত দিবেন তখনই শুরু করব। আল্লাহ তো কুরআনে বলেই দিয়েছেন যে আমি
যাকে ইচ্ছা তাকে হিদায়াত দেই...
ঘটনা ৩ :
প্রভাঃ অ্যাপোলোতে
যদি সাথে সাথে নিয়ে যাইতি, তাহলে এমনটা হইত না......এবারের মত আঙ্কেলের জানটা
বেঁচে যাইতো......
উপরের
ঘটনাগুলি সবই কাল্পনিক। কিন্তু এগুলো খুব ‘কমন’ ঘটনা যা আমরা আশে পাশে হরহামেশাই
শুনি। তাক্বদীরে বিশ্বাস আমাদের ঈমানের ছয়টা পিলারের একটা। আর ঈমানের যে স্তম্ভটা
মানুষের কাছে সবচেয়ে ঘোলাটে লাগে সেটা সম্ভবত তাক্বদীরে বিশ্বাস। আল্লাহ সবকিছু
লিখে রেখেছেন, আবার আমি আমার কাজের জন্য জবাবদিহি করব, এটা আপাত দৃষ্টিতে কেমন যেন
সাংঘর্ষিক লাগতে থাকে অনেকের কাছেই।
আমি
প্রায়ই মানুষকে বলি যে আমরা যারা মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেছি তাদের আসলে
ঈমানের স্তম্ভগুলো নিয়ে স্বচ্ছ ধারণা অর্জন করা দরকার সবার আগে। কারণ ঈমান যদি ঠিক
না থাকে তাহলে আমল করে কোনো লাভ নেই। আর ইসলামের মূল বিষয়গুলো কোনোটাই আসলেই রকেট সাইন্স
না।খালি একটু আন্তরিকতা নিয়ে শয়তানের ওয়াস ওয়াসা থেকে আশ্রয় চেয়ে দুআ করে পড়লেই
ব্যাপারটা ক্রিস্টাল ক্লিয়ার হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ।
তাক্বদীরে
বিশ্বাসের মূলত চারটা অংশ রয়েছে---
এখন আমরা এই অংশগুলো একটু ব্যাখ্যা করব...
ব্যাপারটা
বোঝার জন্য আমরা আবারো একটা কাল্পনিক ঘটনার অবতারণা করব।
শিল্পী
একটা কলেজে পড়ায়। ওর ক্লাশে মাত্র ১০জন ছাত্রী। সবাইকে ও একদম হাড়ে হাড়ে চেনে। ওর একজন
ছাত্রী হল নীরা। মেয়েটা চরম ফাঁকিবাজ। ওকে একদিন ডেকে নিয়ে শিল্পী সাবধান করে বলল
যে ও যদি এভাবেই গাছাড়া থাকে, তবে ও লিখে দিতে পারে যে টেস্টে নীরা ফেল করবে।
শিল্পীর
অনুমান ভুল হয় নি। টেস্টে আসলেই উতরাতে পারল না নীরা.........
এখন পাঠক
আপনারা বলেন যে নীরা যদি এসে বলে যে শিল্পী ওকে বাধ্য করেছে ফেল করতে তবে কি এটা
ঠিক? কী শিল্পীকে এমন সঠিক অনুমান করতে সাহায্য করল? টিচার হিসেবে দীর্ঘদিনের
অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান, তাই না? কিন্তু এটাতো ভুল হতেই পারত......তাই না? কারণ শিল্পী
একজন মানুষ এবং তার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
এবার এই
বিষয়টা দিয়ে আমরা তাক্বদীরের ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করব। আমরা কে কী করব না
করব......এগুলা সবই আসলে আল্লাহ জানেন কারণ তাঁর জ্ঞান অসীম এবং পারফেক্ট। এই
জ্ঞান শুধু যা হচ্ছে তার ব্যাপারে না, যা হতে পারত, তার মাঝেও পড়ে। যেমন আল্লাহ
কুরআনে বলছেন যে যারা সীমালঙ্গনকারী, তারা পরকালে আল্লাহকে দেখার পর আর একবার
দুনিয়াতে ফিরে আসার সুযোগ চাইবে। তার উত্তরে আল্লাহ বলছেন যে ওদেরকে আবার সুযোগ
দেয়া হলেও ওরা প্রথমবারের মতই আচরণ করবে। এই যে কী হলে কী হবে, এটাও আল্লাহ জানেন।কিন্তু
এই জানার অর্থ কখনোই না যে তিনি আমাদের কোনো কাজ করতে বাধ্য করেন!
আর কী
হবে না হবে এটা সবই আল্লাহ লিখে রেখেছেন। এমন না যে আল্লাহ ভুলে যাবেন বলে লিখে
রেখেছেন...কিন্তু আল্লাহ ইচ্ছা করেছেন, তাই লিখে রেখেছেন।
এখন এই
লেখাটার আবার কয়েকটা স্তর আছে।
১মঃ
লাওহে মাহফুযের লেখা
২য়ঃ মায়ের
পেটে থাকতে লেখা
৩য়ঃ লাইলাতুল
ক্বদরের সময়ের লেখা
এখন এর
মাঝে লাওহে মাহফূযের লেখাটা অপরিবর্তনীয়। এখানে একদম বিস্তারিত লেখা আছে।
এখন
প্রশ্ন হতে পারে যে তাহলে দুআতে কি ভাগ্য পরিবর্তন হয়? হয়, তবে ৩য়টা। বাৎসরিক ভাবে
যে লেখাটা হয়, সেখানে পরিবর্তন আসতে পারে।
ব্যাপারটা
একটা MCQ প্রশ্নের মত। হয়ত আল্লাহ ঠিক করে
রেখেছেন-
আয়ূ-
ক)কিছুই
না করলে ৪৫ বছর
খ) ৫০ বছর যদি ওষুধ খায়
গ) ৫৫ বছর ওষুধ + দুআ
এখন আপনি
কী করবেন তার উপর নির্ভর করছে ক, খ নাকি গ। মানে ভাগ্য পরিবর্তন হয়, শুধু একটা
অপশন না। এখন কী কী অপশন দিবেন এটা আল্লাহ ঠিক করে রেখেছেন। এখানে আপনার আমার কোনো
হাত নাই। তাই যেহেতু অপশনের মাঝে নাই, তাই কখনোই এটা ৬০ বছর হবে না। আবার বিদেশে
গিয়ে চিকিৎসা করাটা অপশনে আল্লাহ রাখেন নাই। তাই করলেও লাভ হবে না। ব্যাপারটা একটা
ডায়াগ্রামের মাধ্যমে আমরা দেখতে পারি-
আবার
ব্যাপারটা এমন হতে পারে যে পরিণতি একই হবে কিন্তু সেটাতে পৌঁছাতে আপনি কোন পথ বেছে
নিবেন এটা আপনার ইচ্ছা। একটা উদাহরণ দেই-
একবার এক
ব্যক্তি (ক) আরেক লোককে (খ) বলল যে ঊনার
ঘোড়াটা যেন একটু দেখে রাখে, সে একটু এক বাসা থেকে আসতেসে। ক লোকটা মনে মনে ভাবল যে
ফিরে এসে খ কে ১০০ টাকা দিবে পারিশ্রমিক। কিছুক্ষণ পর এসে দেখে খ লোকটা ঘোড়ার
লাগামটা নিয়ে হাওয়া হয়ে গেছে এবং সে বাজারে ১০০টাকা দিয়ে ওটা বেঁচে দিল।
এখানে
দেখেন যে আল্লাহ ঊনার ভাগ্যে ১০০ টাকা লিখে রেখেছিলেন। কিন্তু খ কোন পথে সেটা পাবে
সেটা ওর সিদ্ধান্ত। তাই মানুষ হারাম উপায়ে যেটা অর্জন করে আল্লাহ আসলে অন্যভাবে
তার জন্য ওই পরিমাণই লিখে রেখেছিলেন। এমন না যে হারাম পথে সে তার রিযিক্ব বাড়ায়।
এখন লাওহে
মাহফূযের লেখাটা বদলায়না কেন? কারণ আল্লাহ আবার জানেন যে আপনি কোনটা করবেন। ক, খ
নাকি গ। আর যেটা করবেন, সেই ফাইনালটা লেখা আছে লাওহে মাহফূযে।
তাহলে
আমরা বুঝলাম যে মানুষ তার নিজের কর্মের জন্য দায়ী। প্রথম ঘটনাতে আন্টি যদি দ্বীনের
কথা বিয়ের সময় চিন্তা করতেন, হয়ত তাহলে আল্লাহ তার স্বামীর মাঝে পরিবর্তন আনতেন...
কিন্তু সে কি সিদ্ধান্ত নিবে এটাও আল্লাহর
ইচ্ছাধীন। কোনো সৃষ্টির পক্ষে আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়।
এটা
হচ্ছে তাক্বদীরে বিশ্বাসের ৩য় অংশ-আল্লাহর ইচ্ছা। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে যে আল্লাহ
কি তাহলে ইচ্ছা করেন যে মানুষ খারাপ কাজ করুক?
উত্তর
হচ্ছে আল্লাহর ইচ্ছা দুই ধরণের।
ক)
সৃষ্টিগত ইচ্ছা
খ) শরঈ
ইচ্ছা
সৃষ্টিগত
ইচ্ছা হচ্ছে এই মহাবিশ্বে যা কিছু ঘটছে কোনো কিছুই তার ইচ্ছার বাইরে ঘটছে না। এটা
তাঁর ক্ষমতার সাথে সংশ্লিষ্ট। কোনো কিছু তাঁর ইচ্ছার বাইরে ঘটতে পারে না,
অস্তিত্বই লাভ করতে পারে না। কিন্তু তার অর্থ এটা না যে যা ঘটছে তার সব কিছু তিনি
পছন্দ করেন।
যা ঘটা
তিনি পছন্দ করেন বা চান যে ঘটুক, সেটাকে বলে
শরঈ ইচ্ছা। যেমন তিনি চান যে সব মানুষ ইসলাম পালন করুক। কিন্তু তিনি যা
পছন্দ করেন তা সবসময় ঘটে না, যদি তার সৃষ্টিগত ইচ্ছার সাথে এটা সাংঘর্ষিক হয়। আমরা
যখন বলি যে আল্লাহ না চাইলে তো গাছের পাতাও নড়ে না...তখন আমরা আল্লাহর সৃষ্টিগত
ইচ্ছার কথা বলি।
তাই যখন
কেউ বলে যে আল্লাহ চাচ্ছেন না তাই আমি হিদায়াত পাচ্ছি না......সে এখানে আল্লাহর
সৃষ্টিগত ইচ্ছার কথা রেফার করছে। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে আল্লাহর এই
সৃষ্টিগত ইচ্ছা আল্লাহর ন্যয়বিচারের সাথে সংশ্লিষ্ট। আল্লাহ যাকে হিদায়াত দেন না,
সে হিদায়াত পাওয়ার মত কাজ করে না বা শর্ত পূরণ করে না বলেই দেন না......
আবার যদি
আগের পর্বের ডায়াগ্রামটার কথা চিন্তা করি এবং ২য় ঘটনাটার কথা ভাবি----তাহলে বুঝব
হয়ত নিতুর বোনের ভাগ্যে এভাবে লেখা আছে-
এখন এই
যে মানুষ চেষ্টা করবে, তারপর ভালো কাজ করবে......তার এই চেষ্টা, ইচ্ছা করার
ক্ষমতা, কাজ সবই আবার আল্লাহর সৃষ্টি। শুধু মানুষই আল্লাহর সৃষ্টি না, মানুষের
কাজও আল্লাহর সৃষ্টি। মানুষ চাইলেও কোনো কাজ করতে পারে না, তার জন্য যে ক্ষমতা
দরকার সেটাও আল্লাহর কাছ থেকে আসতে হয়। নিচে ব্যাপারটা বুঝানোর চেষ্টা করা হল-
অর্থ্যাৎ
মানুষকে সীমিত আকারে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে, একটা নিয়ন্ত্রণ রেখার বলয়ের মধ্যে। এই সীমিত
স্বাধীনতা বা সিদ্ধান্তের জন্যই সে জিজ্ঞাসিত হবে, যা তার সাধ্যের বাইরে সেটার
জন্য তাকে জবাবদিহিও করতে হবে না।
এখন
প্রশ্ন হতে পারে যে মানুষ যা খারাপ কাজ করে, বা মানুষের জন্য খারাপ কিছু আল্লাহ
সৃষ্টি করলেন কেন বা সৃষ্টিগত ইচ্ছার মাঝে মানুষের জন্য খারাপ এমন কিছু পড়ে কেন।
উত্তর
হচ্ছে absolute evil বলে কিছু নেই। ডাক্তার
যখন হাত কাটে চিকিৎসার জন্য, আমাদের ব্যাথা লাগে, সেটা কষ্টকর ব্যাপার। কিন্তু আসলে
এটা ভালো।
আমাদের
জীবনে এমন বহু ঘটনা আছে যেগুলো প্রথমে আমাদের কাছে খারাপ লেগেছে, পরে বুঝেছি যে
সেটাই আমাদের জন্য সবচেয়ে ভালো ছিল। তাইতো আমরা বলে থাকি যে আল্লাহ যা করেন ভালোর
জন্যই করেন, যদিও বা কী ভালো, সেটা আমরা আমাদের সীমিত বুদ্ধি দিয়ে টের নাও
পাই.........
এখন
তাক্বদীরে বিশ্বাসের ব্যাপারে একটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে যে যা হয়ে গেছে, তা আমরা
কোনোভাবেই বদলাতে পারব না।তাই এটা নিয়ে কথা বলা ইসলামে খুবই অপছন্দনীয়। যেমন ধরেন
৩য় ঘটনাটা- প্রভা যে বলছিল যে ওর আঙ্কেলকে অন্য হসপিটালে নিলে বেঁচে যেত, এটা
বিশ্বাস করাটা ভুল। তাই আমরা বলতে পারি যে অতীতের ব্যাপারে আমরা বিশ্বাস করি যা
ঘটেছে তা অলঙ্ঘনীয় ছিল, সেখান থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি, কিন্তু তা বদলাতে পারি
না, কিন্তু ভবিষ্যতের ব্যাপারে এখনো আমাদের অপশন ক, খ, গ ইত্যাদির মাঝে বেছে নেয়ার
সুযোগ আছে মনে করে চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকি......
শেষ কথাঃ
তাক্বদীরে
বিশ্বাসের নানা দিকের মূল নির্যাস আসলে আল্লাহ কে, কেমন এই ব্যাপারটা সম্পর্কে
সম্যক উপলব্ধি। আল্লাহকে না চেনার কারণেই আসলে যত সংশয়ের জন্ম হয়। আমি এখানে
চেষ্টা করেছি হাদীস কুরআনের রেফারেন্স না দিয়ে ব্যাপারটা সহজভাবে বুঝাতে। কিন্তু
এটা এমন একটা বিষয় যে বারবার পড়তে হয়। যত বেশী উদাহরণ, তত বেশী ক্লিয়ার হয়। কিন্তু
তাতে আরো বড় হয়ে যাবে বলে আর লিখলাম না।
বিষয়টি
নিয়ে শুনতে চাইলে বাংলায় একটা লেকচার আছে, ওটা শুনতে পারেন।
No comments:
Post a Comment