Tuesday, July 2, 2019

নোমান আলি খানের মালয়শিয়া সফরে ভলান্টিয়ার হবার অভিজ্ঞতা -৩


২য় পর্বের লিংক
এখানে এখন তুলে ধরব প্রথম দিনের টক শেষে ভলান্টিয়ারদের সাথে ঊনার যে special Question Answer session ছিল, তাতে ঊনি যেসব টিপস দিয়েছেন সেগুলার কথা।

কুরআন মুখস্থ করার সহজ উপায়ঃ

একজন জানতে চাইল যে কিভাবে একজন তাড়াতাড়ি কুরআনের বেশ ভালো একটা অংশ মুখস্থ করে ফেলতে পারে। ঊনি তাকে বললেন যে সূরা বাক্বারা এবং আল ইমরান বড় সূরা হলেও এগুলো মুখস্থ করা সহজ। তাই ঊনি জানালেন যে সূরা বাক্বারা, আল ইমরান এবং ৩০তম পারাটা যদি মুখস্থ থাকে আমাদের, তাহলে কুরআনের প্রায় ৮০% শব্দ আমাদের জানা হয়ে যাবে, তখন অন্য অংশ শুনলেও আমরা কুরআন বুঝতে পারব। যারা নিজস্ব উদ্যোগে কুরআন মুখস্থ করছেন,তাদের জন্য এটা বেশ কার্যকরী টিপস।

সব দাওয়াহ প্রোগ্রামেই কি আমার থাকা চাই?

বরাবরের মত এবারো ঊনি ভলান্টিয়ারদের তাদের নিয়্যতের ব্যাপারে সাবধান করলেন। আরো মনে করিয়ে দিলেন তাদের পারিবারিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা। এইসব কাজ করতে গিয়ে আমরা যেনো মা-বাবা, স্বামী ও সন্তানদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব অবহেলা না করি।

সবচেয়ে জরুরী যেটা তুলে ধরলেন, তা হল সব ব ব প্রোগ্রামে অংশ নেয়ার বা ভলান্টিয়ার হতে চাওয়ার যে প্রবণতা, তার ক্ষতিকর দিকটা। বললেন এত যদি ছুটতে থাকি আমরা তাহলে যে জ্ঞান অর্জন করছি তার উপর আমল করার ফুসরত পাওয়া যাবে না।

ঊনি যখন এই কথাগুলো বলছিলেন-------আমার চোখের সামনে তখন ভেসে উঠছিল একটা মেয়ের ছবি............মেয়েটা তখন ভার্সিটিতে পড়ে। জীবনে নানা ধরণের সাফল্য পেয়ে আকাশে ঊড়তে থাকা তাকে কে যেন একদিন হঠাৎ করেই মাটিতে আছড়ে ফেলল। সবিস্ময়ে সে আবিষ্কার করল এই ২২ বছরের জীবনে তাকে কেউ সত্যিকারের সাফল্যের সংজ্ঞা বলে দেয় নাই। এই সমাজ আর পরিবার তাকে জীবনের উদ্দেশ্য কি তা জানায় নাই। তখন সে পাগলের মত যেখানে ইসলামিক ক্লাসের কথা শুনত, সেখানেই ছুটত। প্রতিদিন ক্লাসের পর কোথাও না কোথাও যেত...বাসে ঝুলে ঝুলে......না খেয়ে না দেয়ে! পড়াশোনাও ছেড়ে দিতে চেয়েছিল! মনে করত এইসব সুদের হিসাবের পড়াশোনা পড়ে কি হবে! বাসার লোকজন ভয় পেয়ে তাকে বকাবকি শুরু করেছিল...তাকে extremist বলে অভিহিত করছিল! আর তাতে বাসার সবার উপর তার রাগ আরো বেড়ে যাচ্ছিল। সে তাদের সাথে চিল্লাচিল্লি করত আর বলত আমি এখন মরে গেলে আমার হিসাব কি তোমরা দিবা? এমন করতে করতে একদিন সে খুব অসুস্থ হয়ে পড়ল। তখন তাকে ফিরে আসতে হল সেই মায়ের আঁচল তলেই যার সাথে কিনা সে প্রতিদিন চিল্লামিল্লা করত। সে তার আচরণ দিয়ে ইসলামের সৌন্দর্যকে মানুষকে দেখাতে ব্যর্থ হল, হয়ত বা প্রকৃত ইসলাম থেকে তাদের আরো দূরে সরিয়ে দিয়েছিল! তারা হয়ত ভেবেছিল ওর মত করে ইসলাম পালন করতে গেলে যদি এমন পাগলামি করতে হয়, তবে দরকার নেই অমন ইসলামের... অথচ সে একবারো বুঝেনি, সমস্যাটা ছিল তার ইসলাম পালনেই!......ইসলাম জীবনে আসলে সবার আগে ব্যবহারটাকে সুন্দর হতে হয়। সে বোঝেনি দশ জায়গায় না গিয়ে দুই জায়গায় গিয়ে অল্প যাই শিখল, তার উপর আমল করাটাই বেশী দরকার ছিল!

মেয়েটা কে তা নিশ্চয়ই এখানে আর বলে দিতে হবে না...তবে আলহামদুলিল্লাহ পরে সেই মেয়েটাই মালয়শিয়া এসে বহু প্রোগ্রামের মধুর হাতছানি অম্লান বদনে ত্যাগ করেছে কারণ সেগুলো ছুটির দিনে ছিল। সারা সপ্তাহের যে একটা দিন জামাই বাসায় থাকে, ওইদিন নিয়মিত যদি সে সারাদিন বাইরে থাকে, তবে অনেক অনেক জ্ঞান হয়ত বা অর্জিত হবে কিন্তু তা গ্রন্থগত জ্ঞানই রয়ে যাবে....তার চাইতে জামাই এর হক্ব আদায় করা আল্লাহ্‌র কাছে বেশী পছন্দনীয়। আগেও বলেছি.........ইবাদাত সবসময় তা না যা আমরা করতে চাই, বরং অনেক সময়ই তা-যা করতে আমাদের মন চায় না! আত্মসমর্পণের নির্যাস বুঝি এর মাঝেই বিদ্যমান!

তাইতো উস্তাদ বারবার বলছিলেন অল্প কাজ, যা কিনা নিয়মিতভাবে সম্পাদিত হয়, সেটাই আল্লাহ্‌র কাছে সবচেয়ে পছন্দের। সব দাওয়াতী প্রোগ্রামে গিয়ে, সব অনুষ্ঠানে ভলান্টিয়ার হবার পরও যদি অবস্থা এমন হয় যে আমার আল্লাহ্‌র সাথে একান্তে কথা বলার মত ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি হয় নি,তবে এত কিছু করার আসল উদ্দেশ্যটাই সাধিত হয় নাই আসলে।

কেমন হবে আমার সঙ্গীরাঃ

উস্তাদ বলছিলেন বারবার যে দাওয়াতী কাজ করতে করতে আমরা যেন এমন মানুষ দ্বারাই সবসময় পরিবেষ্টিত হয়ে না থাকি যারা আমাদের কাছ থেকে প্রেরণা পাবে। নিজেদের উন্নতির জন্য আমাদের এমন মানুষের সাহচর্যও দরকার যাদের দেখে আমরা উদ্দীপিত হব। তা না হলে যাত্রাপথে আমরা stuck হয়ে যাবো।

এক বোন জানতে চাইল যে ইসলামে আসার শুরুর দিকে যে উৎসাহ কাজ করে, পড়ে একসময় তাতে কেমন যেন ভাটা পড়ে যায়, কিছুতেই আরে আগের সেই উদ্দীপনাটা ফিরিয়ে আনা যায় না। এটা কি একটা লক্ষণ যে আল্লাহ আগের কাজগুলো কবুল করেন নাই বা তার নিয়্যতে কোনো সমস্যা ছিল?উনি খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে বললেন এটার মানে হল আপনি মানুষ। এই যে উৎসাহের ঊঠা নামা- মানুষের এটা হবেই।কিন্তু খেয়াল করতে হবে যে এটা যেন সাময়িক হয়, স্থায়ী না হয়ে যায়। যদি স্থায়ী হয়, তবে সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ আছে। she should think about that and sort it out.

সত্যবাদী সঙ্গী-হোক না সে Non practicing কেউ----আছে কি আমাদের জীবনে?

এই point টা আমার মাঝে সেদিন খুব strike করেছিল।ঊনি বলছিলেন শেখ উমার সুলাইমানের কথা----- ঊনার একটা স্কুল ফ্রেন্ড আছে যে অমুসলিম এবং একজন গড় পড়তা অমুসলিম। সে সব কিছু করে---মদ্যপান, জুয়া খেলা সবকিছু। সে নাকি শেখের ভুল ধরে। বলে কথা বলার সময় শেখ নাকি পয়েন্টে stick থাকতে পারেন না......খেই হারিয়ে ফেলেন। এবং শেখ নাকি ঊনার সমালোচনা খুব মন দিয়ে শুনেন ও তার পয়েন্টগুলো অনুযায়ী নিজেকে সংশোধন করার চেষ্টা করেন!

আমাদের নিজেদের চারপাশে তাই তাকানো দরকার যে নির্মম সত্য কথাটা বলার মত কেউ আছে কিনা। সেই কথাটা যে বলবে, তাকে যে practicing হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। শুধু দেখতে হবে সে সত্যবাদী কি না.........

এবার আবারও আমার সামনে ভেসে উঠল ওই মেয়েটার ছবি। তার কিছু ভুলের কথা কিছু মানুষ বারবার বলত। কিন্তু যারা বলত তারা practicing ছিল না বলে সে তাদের কথাগুলো আমলেই নিত না। সেই মেয়েটা একটা বড় ধাক্কা খেয়েছিল তার ব্যাপারে অনুরূপ নেতিবাচক মূল্যায়ন যখন practicing মানুষেরা করেছিল! আসলে The truth remains as a truth, no matter who speaks that L

নিজের সমালোচনা- সেটা সহ্য করা বড় কঠিন আসলে।নিজের ঢোল পিটাতে কার না ভালো লাগে! জান্তে কিংবা অজান্তে! আর এখানেই রিয়ার ভয়টা চলে আসে। মানুষের প্রশংসা কুড়ানোর জন্য কাজগুলো হয়ে যাচ্ছে নাতো? আসলে আল্লাহ জানেন যে আমাদের প্রশংসা পেতে ভালো লাগে। তাই যেহেতু দুনিয়াটা একটা পরীক্ষা ক্ষেত্র, তাই আল্লাহ চান যে আমরা এখানে আমাদের এই ভালো লাগাটাকে অবদমন করে রাখি। কিয়ামতের দিন লক্ষ কোটি মানুষের সামনে আল্লাহ আমাদের কাজের প্রশংসা করবেন। আজকের আত্মনিয়ন্ত্রণের বদলে আল্লাহ আমাদের ওইদিন বিশাল প্রতিদান দিবেন......সুবহানাল্লাহ!

হৃদয়- একটা সংবেদনশীল কাঁচের ঘর?

২য় পর্বে লিখেছিলাম যে ঊনি নিজে পরে ব্যাখ্যা করেছিলেন যে কেনো ঊনি এভাবে গায়ের উপরে উঠে গিয়ে পারলে ছবি তুলতে চায়, এটাকে allow করেন। কারণটা এতক্ষণে নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পেরেছেন সবাই?-------কারণ ঊনি কাউকে আঘাত দিতে চান না।বিশেষ করে মালশিয়ার মত জায়গায় এটা করারতো প্রশ্নই উঠে না। যেমনটা আমি বলেছি যে এখানকার মানুষের মনটা এক্কেবারে পরিষ্কার। এরা ঘোর প্যাঁচ কম বুঝে।  আমি পরে চিন্তা করে দেখেছি যে ঊনি ঊনার যে ইমেজটা ধরে রাখতে চান আসলে, সেটার জন্য এই আচরণগুলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের Q/A সেশনে ঊনি বারবার বলছিলেন কেউ যেন ছবি না তোলে। তারপরও মানুষ সমানে ফ্ল্যাশ অফ করে ছবি এমনকি ভিডিও করে যাচ্ছিল। একজনকে সরাসরি বললেন যে  আমি যা বলছি সেটা মন দিয়ে শুনো, নোট নিও না এখন। তবুও সে উস্তাদের কথাগুলো লিখে যাচ্ছে। চোখের সামনে এভাবে কথা শুনছে না দেখেও কিভাবে একটা মানুষ তার সাথে হাস্যমুখী থাকতে পারে, সেটা আমার মত মাথা গরম মানুষের পক্ষে বোঝা কঠিন আসলে।
পরের দিনের Linguistic Miracle এর টকে ঊনি বলছিলেন আমেরিকাতে অনেক মায়েরা নাকি জোর করে তার ছেলেমেয়েদের ঊনার প্রোগামে নিয়ে আসে। আর সেসব ছেলে মেয়েরা চোখ মুখ কালো করে ঊনাকে বলে যে আমার মা বাধ্য করেছে তোমার এখানে আসতে। ঊনি উত্তরে ওদেরকে কি বলেন জানেন? ভাবতে পারেন?
উত্তরটা রয়েছে পরের পর্বে, যেটাই কিনা শেষ পর্ব ইনশাল্লাহ।

শেষ পর্ব 





No comments:

Post a Comment

রিবা নিয়ে জানা সিরিজের স্ক্রিপ্ট -১১

রিবার নানা রূপ আজকের পর্বে আমরা রিবার নানা রূপের সাথে পরিচিত হব যেন দৈনন্দিন জীবনে আমরা সেগুলো থেকে বেঁচে থাকতে পারি-   টাকা ধার নেয়ার...