সূরা বাক্বারার ১০২-৩ আয়াতদ্বয় বুঝতে হলে আমাদের
কিছু ব্যাকগ্রাউণ্ড তথ্য দরকার।
আমরা
হয়তোবা জানি যে মুসা
আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময়ে যাদুবিদ্যার খুব বেশী প্রচলন ছিল। উনার সাথে যাদুকরদের
ঘটনাও আমরা বিস্তারিত উল্লেখ করেছি। কিন্তু এই যাদুবিদ্যার চর্চা ছিল মিশরের
ফেরাউনের অনুসারীদের কাজ। শোনা যায় যে ফিরাউন নিজেও এই কাজ করতো আর সেজন্যই নীল
নদের প্রবাহ ওর নির্দেশে (আল্লাহর অনুমতিক্রমে) নিয়ন্ত্রিত হত (৪৩:৫১)। কিন্তু
তার কবল থেকে উদ্ধারের পর বনী ইসরাঈলদের জন্য মুসা আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে যে
শরীয়ত নির্ধারিত হয় তাতে যাদুবিদ্যা নিষিদ্ধ ছিল।
কিন্তু
বনী ইসরাঈলদের অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে মিশরীয়দের অধীনে থাকাকালীন অভ্যাসগুলো থেকে
বেরিয়ে আসতে পারছিল না। মূর্তিপূজার মত এক্ষেত্রেও তাদের মাঝে যাদুবিদ্যার চর্চা
চলে আসছিল। সুলাইমান আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর শাসনামলে এটাকে জোরপূর্বক নিষিদ্ধ করে
দেন। তিনি একটা বৈপ্লবিক কাজ করেন, যেসব বই পুস্তক যাদুবিদ্যা
চর্চা ও শেখানোর কাছে ব্যবহৃত হত সেগুলো সব একসাথে নিয়ে একটি খুব নিরাপদ ভল্টে
রেখে দেন যেন এগুলো একেবারে বন্ধ হয়ে যায়।
কাহিনীর চমকটা এইখানেই। এভাবে যাদুচর্চা বন্ধ
করে দেয়ায় যারা এই কাজ করতো তারা উনার উপর খুবই ক্ষুব্ধ ছিল। তারা উনার নামে অপবাদ
দেয়া শুরু করে যে সুলাইমান আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্যকে নিষেধ করলে কী হবে, নিজেই এই
কাজ করে জ্বীনদেরকে বশীভূত করেন ও তাদের দিয়ে নানারকম কাজ করিয়ে নেন। কেউ যেন তাঁর
প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত না হতে পারে সেজন্যই তিনি আসলে জোরপূর্বক এই
কাজগুলো বন্ধ করিয়েছেন (আস্তাগফিরুল্লাহ)। আল্লাহ্ যে বিশেষভাবে উনাকে
এই ক্ষমতা দিয়েছেন এবং উনি যা কিছু করেন সবই যে আল্লাহর অনুমতিক্রমে সেটা তারা
বিশ্বাস করতে চাইতো না। মোটকথা হচ্ছে যাদু ও আল্লাহর মুযিজার মধ্যে পার্থক্য বুঝতে
তারা অপরাগ ছিল......
এখানে উল্লেখ্য যে মুসা আলাইহি ওয়াসাল্লামের
সময়ে যাদুকররা উনার মুযিজা দেখার সাথে সাথে ঈমান এনেছিল কারণ এ ফিল্ডে তাদের
অসামান্য পারদর্শীতা ছিল এবং সেই জ্ঞান দিয়ে তারা বুঝতে পেরেছিল যে এটা মুযিজা, যাদু নয়। এই
জ্ঞান বনী ইসরাইলীয়দের ছিলো না। তাই আল্লাহ্ সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি তাদেরকে
যাদুবিদ্যা শিক্ষা দিবেন যাতে তারা যাদু ও মুযিজার মাঝে পার্থক্য বুঝতে পারে। এই
উদ্দেশ্যে তিনি হারুত ও মারুত নামে দুইজন ফেরেশতাকে পাঠালেন যারা মানুষকে এটা
শেখানোর আগেই বলে নিত যে এটা তোমাদের জন্য পরীক্ষা। আমরা তোমাদেরকে এটা শিখাচ্ছি, কিন্তু যদি তোমরা এটা প্রয়োগ
করো তবে তা তোমাদের ইসলামের বাইরে নিয়ে যাবে......
এই ভয়াবহ পরিণতি
সম্পর্কে জানা থাকা সত্ত্বেও তাদের মাঝে কেউ কেউ সেটা ঠিকই প্রয়োগ করা শুরু করলো।
এই ঘটনাটা সম্পর্কে কুরআন আমাদের জানাচ্ছে উপরের আয়াত দুটোতে।
যাদেরকে যাদুবিদ্যা শিখানো হয়েছিলো, তাদের
একটি অংশ কুফরি জেনেও এটা নিজেদের মাঝে প্রয়োগ করা শুরু করেই ক্ষান্ত হয় নি,
এটাকে তাদের ধর্মের অংশ বানিয়ে ফেলেছিলো, ঠিক
এখন যেমন কুফরি কালামের অধিকাংশই হয় এক শ্রেণীর হুজুরদের দ্বারা। ইহুদী ধর্মের
সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে থাকা জ্ঞানের এই শাখা মূলত Qabbalah নামে
পরিচিত। আপনি যদি এই নাম লিখে সার্চ দেন গুগলে তাহলে দেখবেন যে এটা একধরণের Mystic
Branch. এর মূল থিম হচ্ছে সংখ্যাতত্ত্ব যা দিয়ে নানা ধরণের
যাদুবিদ্যা চর্চা করা হয়...
দুঃখজনক হলেও সত্যি যে এই সংখ্যাতত্ত্বের
ব্যাপারটা খুব সূক্ষ্মভাবে ইসলাম ধর্মের মাঝেও
প্রবেশ করেছে। আমাদের অনেকের হয়তো মনে আছে যে ছোটবেলায় আমাদের মুরুব্বীরা চিঠির
উপরে লিখতেন ৭৮৬, যেটার অর্থ নাকি
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আমি প্রথম যখন ছোটবেলায় এটা শুনেছিলাম খুব অবাক
হয়েছিলাম যে ৭৮৬ র মানে এটা হয় কিভাবে! আসলে এটার উৎস হচ্ছে এই সংখ্যাতত্ত্বের
শাস্ত্র যেখানে একেকটি আরবী শব্দের বিপরীতে একেকটি
সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়। যেহেতু কোন সংখ্যার বিপরীতে কোন শব্দ আছে তা সাধারণ জনগণের
জানার কোনো উপায় নেই, তাই এর মাধ্যমে মানুষকে
ইচ্ছামত বোকা বানানোর সুযোগ থেকে যায়। তাই দেখা যায় আল্লাহর কালাম লেখা আছে ভেবে
অনেকে যে তাবিজগুলো ব্যবহার করা হয় সেগুলোতে আসলে এসব শয়তানী বিদ্যার সূত্র লেখা
হয়, কিন্তু বলা হয় যে এগুলো বিভিন্ন সূরার প্রতীক! আপনি যদি
কখনো কোনো তাবিজ আসলে খুলে দেখেন তাহলে দেখবেন যে সেখানে মোটেও আরবীতে কুরআন লেখা
নেই বরং দুর্বোধ্য কিছু নকশা লেখা আছে। আদতে সেগুলোর মাধ্যমে কোনো শয়তানের আশ্রয়
চাওয়া হয় বা শয়তানের ইবাদাত করা হয়! একবার রুকিয়ার (শরীয়াত সম্মতভাবে জ্বীন
তাড়ানোর উপায়) উপর একটা কোর্স করেছিলাম, তখন শিক্ষক উপস্থিত
দর্শকদের বললেন কারো সাথে যদি তাবিজ থেকে থাকে তবে সাথে সাথে যেন তা খুলে ফেলা হয়
কারণ তা সন্দেহাতীতভাবে শিরক। তারপর বললেন যে সবাই যেন সেগুলো তার কাছে এসে জমা
দেয়। জমাকৃত তাবিজগুলো খুলে খুলে তিনি পড়ছিলেন আর আমাদের বলছিলেন যে সেখানে
বিভিন্ন শয়তানের নাম লেখা আছে, তাদের স্তুতি করে তাদের
সাহায্য চাওয়া হচ্ছে! অর্থাৎ আপনি যখন আপনার নিজের বা সন্তানের গায়ে তাবিজ ঝুলিয়ে
দিচ্ছেন তখন আদতে আপনি তাকে আল্লাহ্ নয় শয়তানের ভরসায় সমর্পণ করছেন! ভাবা যায়?
পরবর্তীতে আমি নিজেও এই কাজ
করেছি। আমার এক আত্মীয়ের গলা থেকে তাবিজ খুলে ভেতরের খোলসটা ভেঙ্গে তাকে
দেখিয়েছি যে এখানে মোটেও সূরা ইয়াসীন লেখা নেই বরং যে নকশা দেয়া আছে সেটা আসলে
শয়তানকে আশ্রয় চাওয়ার তন্ত্র মন্ত্র।
No comments:
Post a Comment