Wednesday, July 3, 2019

সূরা বায়্যিনাহঃ এক ঝলক দেখাঃ২



১ম পর্বের লিংক

আয়াত ৪:

وَمَا تَفَرَّقَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ إِلَّا مِن بَعْدِ مَا جَاءَتْهُمُ الْبَيِّنَةُ 

আর কিতাবীরা তাদের কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পরই কেবল মতভেদ করেছে।
এই আয়াতে শুধু আহলে কিতাবদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে যেখানে প্রথম আয়াতে মুশরিকদের কথাও বলা হয়েছিলএটা কিভাবে হলো?

যাদের “কিতাব দেয়া হয়েছিল”  তারা নিজেদের মাঝে মতভেদ করেছিল তাদের কাছে রাসূল আসার পর ও তাদেরকে স্পষ্ট বাণী পৌঁছে দেয়ার পর – সেই বাণী যা তাদের মাঝে একতা আনার কথা ছিল। উল্লেখ্য যে এখানে উতুল কিতাব أُوتُوا الْكِتَابَ – (যাদের) কিতাব দেয়া হয়েছিল অর্থ্যাৎ passive voice ব্যবহার করা হয়েছে। যেহেতু কিতাবকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেয়া হয় নাই, তাই আল্লাহ এই কাজটা নিজের সাথে সংশ্লিষ্ট করছেন না। যদি ইতিবাচক ব্যবহার উল্লেখ করা হত, তাহলে বলা হত আতাইনা হুম আল কিতাব اَتَيْنَاهُمَا الْكِتَابَ (Active voice).

যাই হোক, বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে মানুষ আলো থেকে অন্ধকারে যাচ্ছে, যেখানে হেদায়েত সত্যিকার অর্থে আমাদের অন্ধকার থেকে আলোতে এনে একত্রিত করার কথা ছিলআমরা এই অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছি যদিও আমাদের কাছে জ্ঞান এসেছে। এই পথটা খুবই ভয়ানক। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? কারণটা আল্লাহ উল্লেখ করছেন অন্যত্র-
মানবজাতি একই সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল; অতঃপর আল্লাহ সুসংবাদবাহক ও ভয় প্রদর্শকরূপে নবীগণকে প্রেরণ করলেন এবং তিনি তাদের সাথে সত্যসহ গ্রন্থ অবতীর্ণ করলেন যেন (ঐ কিতাব) তাদের মতভেদের বিষয়গুলো সম্বন্ধে মীমাংসা করে দেয়, অথচ যারা কিতাবপ্রাপ্ত হয়েছিল, স্পষ্ট নিদর্শনসমূহ তাদের নিকট সমাগত হওয়ার পর, পরস্পরের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষবশতঃ তারা সে কিতাবকে নিয়ে মতভেদ ঘটিয়ে বসল, অতঃপর আল্লাহ তদীয় ইচ্ছাক্রমে বিশ্বাস স্থাপনাকারীদেরকে তদবিষয়ে সত্যের দিকে পথ প্রদর্শন করলেন এবং আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সরল পথ প্রদর্শন করে থাকেন। [আল বাকারা ২:২১৩]

অর্থ্যাৎ ব্যাপারটা এমন না যে প্রমাণের অভাবে মানুষ কনফিউজড হয়ে বিভিন্ন পথে বিভক্ত হয়েছে, বরং কারণ ছিলো নিজেদের ইগো, পরস্পরের প্রতি হিংসা। ধর্মীয় জ্ঞান যেহেতু সমাজে প্রভাব বিস্তারের একটা মাধ্যম এবং এটা সম্মান, সামাজিক অবস্থান ও মনোযোগ এনে দেয়, মানুষ তাদের কথা শুনে তাই এটার উপর ভিত্তি করে হিংসা, বিদ্বেষের জন্ম হতে পারে। এই হিংসা মানুষকে অসৎ করে তুলতে পারে, মানে এমন হতে পারে যে সত্য অনুসরণে তারা আর সৎ ছিল না। তারা তাদের অহংকারের ফলে শুধু প্রতিযোগিতা করতে চাইত। তাই তারা বিভক্তি সৃষ্টি করত।

এই কারণে পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ বলেনঃ

আয়াত ৫:

 وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّـهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاءَ وَيُقِيمُوا الصَّلَاةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ ۚ وَذَٰلِكَ دِينُ الْقَيِّمَةِ

তারা তো আদিষ্ট হয়েছিল আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদত করতে এবং নামায কায়েম করতে ও যাকাত প্রাদান করতে, এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত সঠিক দ্বীন।

এখানে key word হচ্ছে মুখলিসীন – একনিষ্ঠতা। আগের আয়াতে যে অবক্ষয়ের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, সেটাকে দূর করতে পারে স্রেফ এই একটা বৈশিষ্ট্য। ব্যসিক্যালী এখানে এই অবক্ষয়ের বিপরীত দিকটা এবং একজন বিশ্বাসী আলিমের অন্তর সত্যিকার অর্থে কেমন হওয়া উচিত সেটাই বলা হয়েছে। আরো বলা যেতে পারে যে এই অবক্ষয় থেকে বেঁচে থাকার উপায় বলে দেয়া হয়েছে। কারণ অহংবোধ আর একনিষ্ঠতা দুটি বিপরীত বৈশিষ্ট্য যা একই হৃদয়ে সহাবস্থান করতে পারে না।

একটু চিন্তা করলে বুঝবো যে শুধু এই একটা আয়াত গোটা দ্বীনকে আমাদের সামনে তুলে ধরছে।

এই দ্বীন একনিষ্ঠভাবে পুরোপুরি আল্লাহর জন্য, আংশিকভাবে না, খ্যাতি ও ক্ষমতার লড়াইয়ের জন্য না, উপরে বর্ণিত অসৎ আলিম হওয়ার জন্য না। এটা একনিষ্ঠভাবে শুধুমাত্র তাঁর জন্য। আপনি ইসলামের জন্য যা করেন মানুষ যদি তার প্রসংশা না করে সমালোচনা করা শুরু করে তাহলে কি আপনি রেগে গিয়ে যা করছিলেন তা করা ছেড়ে দিবেন? আপনার প্রত্যাশা কি আল্লাহর কাছে ছিল না মানুষের কাছে ছিল? আপনি কি মানুষের কাছে পুরষ্কারের আশা করেছেন না আল্লাহর কাছে? 

হুনাফা – হানাফ; পথভ্রষ্টতা থেকে দূরে সরে যাওয়া। অন্যদের দ্বারা বিচলিত না হয়ে সঠিক পথের ওপর নিবেদিত থাকা।
স্থাপন করা ও বহাল রাখার জন্যঃ
সালাত – যা আল্লাহর প্রতি কর্তব্য।
যাকাত– যা মানুষের প্রতি কর্তব্য
এই সমস্ত কাজ শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করতে হবে।
وَذَالِكَ دِيْنُ الْقَيِّمَةِ
এবং এটাই দ্বীন ক্কায়্যিমাহ।


আয়াত ৬:

 إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ وَالْمُشْرِكِينَ فِي نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ فِيهَا ۚ أُولَـٰئِكَ هُمْ شَرُّ الْبَرِيَّةِ

নিশ্চয়ই কিতাবীদের মধ্যে যারা কুফরী করেছে ও মুশরিকরা, জাহান্নামের আগুনে থাকবে স্থায়ীভাবে। ওরাই হলো নিকৃষ্ট সৃষ্টি।

আহলে কিতাবদের মাঝে অবিশ্বাসীরা ও মুশরিকরা হচ্ছে নিকৃষ্ট প্রাণী। কারণ আল্লাহ তাদের বায়্যিনাহ দিয়েছেন – এমন স্পষ্ট প্রমাণ যার কোন বিরোধিতা করা যায় না – কিন্তু তারা সেটা পরিত্যাগ করেছে। তাই তারা সৃষ্টির নিকৃষ্ট জীব।

আয়াত ৭:
إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ أُولَـٰئِكَ هُمْ خَيْرُ الْبَرِيَّةِ ﴿٧

নিশ্চয়ই যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে তারাই সর্বোৎকৃষ্ট সৃষ্টি।
যারা বিশ্বাস করে ও ভাল কাজ করে, মানে তারা ভিতর ও বাহির দুই দিকেই ভালো। তারা ৪র্থ আয়াতে বর্ণিত খারাপ মানুষদের মতো অসৎ বা মুনাফেক না। তারা হচ্ছেঃ
খায়রুলবারিয়্যাহ – সৃষ্টির সেরা।

আয়াত ৮:
'
তাদের রবের কাছে তাদের পুরষ্কার হবে স্থায়ী জান্নাত, যার পাদদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত, সেখানে তারা থাকবে স্থায়ীভাবে। আল্লাহ তাদের উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন তারাও আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট হয়েছেএটি তার জন্য যে স্বীয় রবকে ভয় করে।

খালিদীনা ফী হা আবাদা - যেখানে তারা চিরকাল বাস করবে – মানব চরিত্রের  বৈশিষ্ট তুলে ধরছে। আমরা পারমানেন্ট রেসিডেন্স, সিটিজেনশিপ চাই। আমরা ভাড়া করতে চাই না, আমরা নিজের বাড়ি চাই। আমরা স্থিরতা চাই –যেখানে কোন বিল নেই, আর্থিক খরচ নেই, কোন ঝামেলা নেই।

পৃথিবীর জীবনে আমাদের যে জিনিস যত বেশি ভালো সে জিনিস দেখে-শুনে রাখতে আমাদের তত বেশি ঝামেলা আর খরচ হয় – তত বেশি কষ্ট করতে হয়।

পরের জীবনে – আপনাকে কোন ধরণের কোন কষ্ট ছাড়াই চিরস্থায়ী প্রাসাদ, স্থিরতা আর সহজতা দেয়া হবে।জান্নাতের পুরষ্কার তার জন্য যে তার রবকে নিজের চেয়ে ও সমাজের চেয়ে বেশি ভয় করবে।

সূরার আরম্ভর সাথে শেষের মিল

এই সূরার শুরুতে বলা হয়েছে কিভাবে পৃথিবীকে বিভক্ত করা হয়েছে, এবং এই বিভক্তি রেখাগুলো বায়্যিনাহ/স্পষ্ট প্রমাণ না আসা পর্যন্ত টানা যাবে না – অর্থ্যাৎ বিভিন্ন ধরণের মানুষের দ্বারা গঠিত সমাজকে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়েছেঃ বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী

এই মানুষরা প্রচন্ড কষ্টের মাধ্যমে (ইনফাকা আল আযম – যেভাবে তীব্র কষ্টের মাঝে দিয়ে হাড় স্বস্থান থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়) তাদের পূর্বপুরুষদের পথ থেকে আর সমাজ থেকে  নিজেদের বিচ্ছিন্ন করেছে কারণ তাদের কাছে বায়্যিনাহ/স্পষ্ট প্রমাণ এসেছে যা তাদের মাঝে নিশ্চিত প্রত্যয়ের জন্ম দিয়েছে এবং তাই তারা মুসলিম হয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে কারণ তারা যখন সমাজ থেকে নিজেদের আলাদা করে ফেলেছে তখন তারা মানুষকে ভয় করেনিতারা এর চেয়ে বেশি কি ভয় করেছে? তারা তাদের সত্যিকার প্রভু – আল্লাহকে ভয় (খাসইয়া) করেছিল

শেষ পর্বের লিংক

No comments:

Post a Comment

রিবা নিয়ে জানা সিরিজের স্ক্রিপ্ট -১১

রিবার নানা রূপ আজকের পর্বে আমরা রিবার নানা রূপের সাথে পরিচিত হব যেন দৈনন্দিন জীবনে আমরা সেগুলো থেকে বেঁচে থাকতে পারি-   টাকা ধার নেয়ার...