২য় পর্বের লিংক
আমার
নিজস্ব উপলব্ধিঃ
সাম্প্রতিক
সময়ে এই সূরাটা বোঝার প্রতি জোর দিচ্ছি কারণ আসলে ২য় পর্বে উল্লেখিত আয়াত ৪-৫।
আমার
মনে আছে যে একটা সময় ছিলো যখন IOU তে পড়ার
সুবাদে আমি ডঃ বিলাল ফিলিপ্সের অন্ধ ভক্ত ছিলাম। ঊনি স্কলার ঊনি কি আর ভুল বলবেন,
এমন একটা মানসিকতা তৈরি হয়েছিলো। বিয়ের পরে অনেক কিছু বেটার হাফের সাথে শেয়ার
করতাম, ঊনি প্রায়ই আরেক দৃষ্টিভঙ্গী তুলে ধরতেন, বলতেন যে যা ঊনার নিজস্ব চিন্তা
ভাবনা, কুরআন হাদীস থেকে বলছেন না, তা তো আমাদের জন্য binding না। আমাদের কারো প্রতি blind loyalty থাকা উচিৎ না।
আমার কথাগুলো ভালো লাগতো না, অস্বীকারও করতে পারতাম না।
তারপর
একসময় IOUতে অ্যাডমিন পদে কাজ করার সময় একজন ইমেইল
করেছিলো ডঃ বিলাল ফিলিপ্সের একটা লেকচারের কিছু অংশের ব্যাপারে আপত্তি তুলে। আমার
দায়িত্ব ছিলো সেটার উত্তর দেয়া। তখন বলা যায় আমি বেটার হাফের কথাটাই ঊনাকে
বলেছিলাম-ভুল সবারই হতে পারে ইত্যাদি।
এরপর
একটা সময় আসলো যখন আমি বেশ কিছু স্কলারের সাথে একদম প্রত্যক্ষভাবে কাজ করলাম, যাকে
বলে একদম হাতে কলমে। তখন আমি স্কলারদের মানবীয় দিকটা যেন আমার চোখের সামনে খুলে
গেলো। আমি দেখলাম তাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, তাদের আবেগ, তাদের ভুলগুলো।
আর
সেইসময় থেকেই আমি উম্মাহর মাঝে যেই ট্রেণ্ডটা নিয়ে সবচেয়ে চিন্তিত সেটা হচ্ছে
স্কলারদের নিয়ে সেলিব্রেটি কালচার। ইস আমার না ঊনাকে কী যে ভালো লাগে, জানিস ঊনার
সাথে না একটা সেলফি তুলেছি, ওমা ঊনি না আমাকে ইমেইল করেছে ইত্যাদি।
আমার
অদ্ভূত একটা এলার্জি হয় এসব কথা শুনলে, দেখলে। এই কালচারের একটা by product হচ্ছে যে স্কলারদেরকে ভুলের ঊর্ধ্বে ভাবা, অমুক যখন
বলেছেন, তখন নিশ্চয়ই জেনে বুঝেই বলেছেন এটা ভাবা। এটা আরো হয় যখন আপনার নিজস্ব
কোনো পড়াশোনা থাকে না, আপনি হুজুগে মাতেন।
এই একই
কালচারের আরেকটা by product হচ্ছে
স্কলারদের বিরুদ্ধে সতর্কীকরণ কালচার। অমুক দাঈ/ আলিম অমুক কথা বলেছেন, দ্বীন
ইসলামকে বদলে দিচ্ছেন, তাই আমাদের দ্বীনকে বাঁচাতে হলে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে যেন তাঁর
কথা আর কেউ না শোনে, উম্মাহকে উদ্ধার করতে হবে তাঁর হাত থেকে।
আমার
এনাদেরকে খুব বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে-
১।
কোনো আলিম/ দাঈর সব কথা/ কাজ ঠিক হবে এমনটা কোথায় আছে? আমরা যেভাবে তাঁর আমল নামা
বিশ্লেষণ করছি এক ফোঁটাও ছাড় না দিয়ে, সেভাবে আল্লাহ আপনারটা করলে পার পেয়ে যাবেন
নিশ্চিত?
২। আম
জনতা ঊনার কথা শুনলে বিভ্রান্ত হয়ে যাবে......আপনি কেন আম জনতার কাছে গিয়ে সঠিকটা
শিখাচ্ছেন না? আপনি কি করছেন এখানে?
যাই
হোক, আমি অনেক চিন্তা করেছি যে এমনটা কেন হয়। অনেক দুআও করেছি যেন বুঝতে পারি
সেজন্য। তারপর শিকড়ের সন্ধানে লিখতে গিয়ে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছি। সূরা বাক্বারার
নিচের আয়াতটা ছিলো আমার জন্য একদম eye opening:
যখন
তাদেরকে বলা হয়, আল্লাহ
যা পাঠিয়েছেন তা মেনে নাও, তখন
তারা বলে, আমরা
মানি যা আমাদের প্রতি অবর্তীণ হয়েছে। সেটি ছাড়া সবগুলোকে তারা অস্বীকার করে। অথচ
এ গ্রন্থটি সত্য এবং সত্যায়ন করে ঐ গ্রন্থের যা তাদের কাছে রয়েছে। বলে দিন, তবে তোমরা ইতিপূর্বে পয়গম্বরদের হত্যা করতে কেন
যদি তোমরা বিশ্বাসী ছিলে? (2ঃ৯১)
এখানে
বনী ইসরাঈলের কথা বলা হচ্ছে। আমরা সবাই জানি যে ওরা নিশ্চিতভাবে জানতো রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সত্য ধর্ম নিয়ে এসেছিলেন, তবু ওরা ঈমান আনছিলো না
কারণ ঊনি ওদের গোত্রের ছিলেন না। এখন একটু খেয়াল করে দেখি যে উপরের আয়াতে কী বলা
হচ্ছে-
আল্লাহ
ওদের ঈমান আনতে বলছেন আল্লাহ যা পাঠিয়েছেন তাঁর উপর, মানে source is important, conveyer না। কিন্তু বিপরীতে ওরা কী
বলছে? ওরা শুধু ওদের কাছে যা নাযিল হয়েছে, সেটাই মানবে। খেয়াল করে দেখুন যে
আল্লাহর কন্সেপ্টটা ওরা সরিয়ে দিচ্ছে, মানে ওদের কাছে যা আছে সেটা আল্লাহর পক্ষ
থেকেই হতে হবে জরুরী না, ‘ওদের কাছে যেটা আছে’ সেটাই বেশী জরুরী।
কিন্তু
তারপরে আছে আসল ঘটনা। ওদের কাছে কী আছে, এটাই ওরা জানে না। যদি জানতো তাহলে বুঝতো
যে দুই পক্ষ একই কথা বলছে।
তারপর
আল্লাহ ওদেরকে আরো বলছেন যে তোমরা যদি নিজেদের গোত্রের কাছে প্রেরিত হলেই শুনবা,
তাহলে আগের নবীদেরকে হত্যা করতে কেন?
এখন
আসা যাক কিভাবে আমি এই আয়াতটাকে আমাদের কন্টেক্সটে বোঝার চেষ্টা করছি (এটা
সম্পূর্ণ আমার মস্তিষ্কপ্রসূত, তাই কারো জন্য binding না)।
আমি
যেখানে প্রথম ইসলাম শিখতাম সেখানে একটা কথা খুব প্রচলত ছিলো যে আক্বীদা সহীহ হতে
হবে। সঠিক আক্বীদা যদি অনুসরণ করা হয়, তাহলে আমাদের মাঝে সব ঐক্য চলে আসবে। আমিও
সেটা শুনে ভাবতাম যে কারো আক্বীদায় সমস্যা থাকলে তাঁর কথা শোনা যাবে না, আমাদেরকে
জানানো হত যে কার কার আক্বীদাতে সমস্যা আছে। তারপর একটা সময়ে আমি অবাক হয়ে দেখলাম
যে সেই সতর্ক করার লিস্টটা বড় থেকে বড়ই হচ্ছে। আরো অবাক হলাম যখন দেখলাম যে
আক্বীদাকে একদম কপি পেস্ট করা যাবে এমন মানুষরা আলাদা প্রতিষ্ঠান গড়ছে, গালাগালি
করছে......তাদের একজনের আরেকজনের প্রতি ব্যবহার আমাকে বিস্ময়াহত করলো।
একটা
প্র্যাক্টিকাল উদাহরণ দেই- কিছুদিন আগে একটা বিষয় নিয়ে একটা whatsapp গ্রুপ খোলা হয়। কথা প্রসংগে সে ইয়াসীর ক্বাদীর একটা
লিংক শেয়ার করে বললো যে এই লেকচারটা তাঁর খুব ভালো লেগেছে ইত্যাদি। তখন গ্রুপের
একজন মন্তব্য করলো যে ইয়াসীর ক্বাদীর তো আক্বীদাতে সমস্যা আছে। কোন এক লেকচারে
নাকি ঊনি বলেছেন যে......( আমি সেটা উল্লেখ করছি না)। শুনে আমার এত অবাক লাগলো! এত
সূক্ষ্মভাবে ভুল ধরা তখনই সম্ভব যখন আপনি তাঁর ভুল ধরার জন্যই লেকচারটা শুনছেন
অথবা আপনি ইংরেজী ভাষা বোঝেন না। যাই হোক, আমি তখন বললাম যে বোন, ইয়াসীর ক্বাদী
আমাদের চাইতে কমপক্ষে ১০ গুণ ভালো আক্বীদা বোঝেন, আর আমি নিশ্চিত যে ঊনি এখানে এটা
বোঝান নাই আপনি যেটা বলেছেন। বলে আমি আক্বীদা ইস্যু নিয়ে আমার উপলব্ধিটা তুলে
ধরলাম, ঊনিও আমার বক্তব্যের বিরোধিতা করে বেশ কিছু যৌক্তিক কথাই বললেন। সমস্যা হলো
যে আমার কথাগুলোতে বেশ কিছু সদস্য লাইক দিলো, ঊনারটাতে কেউ দিলো না, মানে আমার
কথায় নিরব সমর্থন জানালো। বাকিরা প্রসংগ বদলানোর জন্য নিজের বাগানের ছবি ইত্যাদি
পাঠাতে থাকলো। মানে টপিকটা ক্লোজ করো আর কী! আমি অবাক হয়ে দেখলাম যে এই ঘটনার পরই
বোনটা গ্রুপ থেকে লিভ নিলেন! সুবহানাল্লাহ! এতটুকু সহ্যশক্তি নেই অথচ যারা আমরা
গ্রুপে ছিলাম কম বেশী সবাই আক্বীদার উপর একই জায়গা থেকে কমপক্ষে ৩টা কোর্স করেছি!
তখন
আমার মনে হতে থাকলো যে সমস্যার উৎস আসলে আক্বীদা না, অন্য কিছু। সেই সময়ে সূরা
বাক্বারার এই আয়াতটা এবং সূরা বায়্যিনাহ বলা যায় আমাকে উদ্ধার করলো। সূরা বাক্বারা
আমাকে জানালো যে এমনটা হয় যখন আমি আমার ‘আমিত্ব’ কে স্থান দেই সত্যের উপরে। আমার
দল, আমার স্কলার, আমার মাযহাব-দিন শেষে আমার কাছে অগ্রাধিকার পেতে থাকে ‘আমি’। আমি
হয়ে যাই চরম exclusive mentality র। ঠিক
বনী ইসরাঈলের মত- আমার কাছে যা নাযিল হয়েছে।
কিন্তু
নিজের এই আমিত্ব বোধের কারণেই আমার সেই লিস্টটা ছোট হতে থাকে, কারণ নিজের দল হলেই
যে আমি মেনে নিবো তা না, একদম আমার মনের মত হতে হবে। ঠিক যেমন নিজের গোত্র হওয়া
সত্ত্বেও বনী ইসরাঈল ওদের নবীদের হত্যা করেছিলো। আমরা হয়তো অন্য দাঈ, স্কলারদের
হত্যা করতে যাচ্ছি না, কিন্তু তাদেরকে discredit করার আপ্রাণ চেষ্টা করছি যাতে তাঁর ফলোয়ার সংখ্যা আমার দলীয় স্কলারের চেয়ে
বেশী না হয়।
কিন্তু
এইখানে মজার ব্যাপার হচ্ছে আমার দল, আমার স্কলার যে কী মত পোষণ করে, সেটা আমি
অধিকাংশ সময়েই জানি না। যদি জানতাম আর খোলা মন নিয়ে বিশ্লেষণ করতাম তাহলে দেখতাম
যে মোটামুটি ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে আমরা একমত হতে পারতাম, যেমনটা আল্লাহ বলছেন যে ওরা
জানেনা যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওদের কিতাবেরই সত্যায়ন করছে।
সূরা
বায়্যিনাহ থেকে নিশ্চিত হলাম যে এই বিভেদের কারণ প্রমাণের অভাব না, বরং এই আমিত্ব।
সবচেয়ে আশার কথা হচ্ছে যে আমি সমাধানটা এখানে খুঁজে পেলাম। সমাধান হচ্ছে- আমাদের
মুখলেস অর্থ্যাৎ আল্লাহর ইবাদাতের ক্ষেত্রে একনিষ্ঠতা বজায় রাখতে হবে।
মানে
শুধু ritual হিসেবে নামায-রোযা করলে হবে না,
সেগুলো আল্লাহর সাথে সম্পর্ক বাড়াচ্ছে কী না সেটা বুঝতে হবে। যদি তা না বাড়ায়,
তাহলে অ্যালার্মিং। যদি তা থাকে, তাহলে ভুল স্কলারের অনুসরণ করলেও, আপনার ব্রেনে
একটা রেড অ্যালার্ম বাজবে যে কোথাও ভুল হচ্ছে। এই একনিষ্ঠতা আপনাকে রক্ষা করলে
সেলিব্রেটি কালচার থেকে, আপনাকে বাঁচাবে ফতওয়া শপিং থেকে।
আরো
একটা উপায় কী? একনিষ্ঠতার সাথে জ্ঞান অর্জন করে যাওয়া। বিশাল লিস্ট নিয়ে বসে একের
পর এক দাঈ, আলিমের ব্যাপারে মানুষকে সতর্ক করার কাজটা সোজা হলেও বেশী effective হচ্ছে সাধারণ মানুষের কাছে এই একনিষ্ঠতাপূর্ণ দ্বীনের
মেসেজ পৌঁছে দেয়া। সেজন্য ফেসবুকের আরাম ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হবে মাঠে- প্রতিবেশী,
পরিবার আর আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে।
আর
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কী? ইস্তেগফার-ক্ষমা চাওয়া আর নিচের দুআটা করা-
হে আমাদের
পালনকর্তা! সরল পথ প্রদর্শনের পর তুমি আমাদের অন্তরকে সত্যলংঘনে প্রবৃত্ত করোনা
এবং তোমার নিকট থেকে আমাদিগকে অনুগ্রহ দান কর। তুমিই সব কিছুর দাতা। (৩ঃ৮)
আমরা
যেন ভুলে না যাই যে আমার সতর্ক করা সবগুলো মানুষকে নিয়ে যদি আমি জাহান্নামে যাই,
আমার কষ্ট কিছু কমবে না, তাই গীবতের মাধ্যমে নিজের কষ্টার্জিত আমলগুলো আরেকজনকে
দিয়ে দেয়ার আগে ১০০বার যেন চিন্তা করি!
আল্লাহ
আমাদেরকে হেফাজত করুন, ফুরক্বান দিয়ে রক্ষা করুন, আমীন।
No comments:
Post a Comment