দেশে থাকতে সূরা হুজুরাতের
উপর একটা দিন ব্যাপী ওয়ার্কশপ হয়েছিল। তখন সেখানে এটার উপর একটা পূর্ণাংগ নোটও
দেয়া হয়েছিল। ওয়ার্কশপটাতে যাওয়ার পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে সূরাটার তাফসীর পড়েছিলাম
বলে মনে পড়ে। সম্ভবত উৎস ছিল তাফহীমুল কুরআন (বাসায় এটাই শুধু ছিল)। বিখ্যাত কয়েকটা আয়াত সূরা
হুজুরাতে আছে বলে ব্রেনে গাঁথা ছিল- ‘গীবত করা মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়ার সমতুল্য’ , অধিক
ধারণা পাপ, আল্লাহর কাছে তারাই সম্মানিত যারা তাকওয়াবান
ইত্যাদি। সূরা হুজুরাতের সাথে আমার পরিচয় এইটুকুই। ওই ওয়ার্কশপে কী শিখেছিলাম বা
তাফসীরে কী পড়েছিলাম তার কিছুই স্মৃতিতে অবশিষ্ট নাই। খুব দাগ কাটার মত কিছু ছিল
না হয়তো, কিংবা আমারই দুর্বল স্মৃতি এটার কারণ!
ব্যায়্যিনাহর Access 1 প্রোগ্রাম
করে আমি যে হাতি ঘোড়া কিছু শিখে গেছি এমনটা না। এটার ৩টা পার্ট আছে, আমি শুধু ১ নংটা করেছি। ইচ্ছা থাকা স্বত্বেও বাকিগুলা করা হয় নাই পিএইচডি
শুরু করে দেয়ায়। সত্যি কথা হচ্ছে যা শিখেছিলাম তার অনেক কিছু ভুলেও গেছি চর্চা না
থাকায়। (পড়ানো শুরু করেছিলাম, সেটাও থেমে গেছে :( ) কিন্তু
এরই মধ্যে আমার নিজের মাঝে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে গেছে- আমি বুঝে গেছি যে
কুরআন আসলে আরবী ভাষায়! কথাটা হাস্যকর মনে হলেও এটা আমার কাছে একটা বিশাল পাওয়া।
আমি এখন আর কুরআনের অনুবাদের উপর ভরসা করতে পারি না। আমি যে আরবীতে কুরআন পুরাপুরি
বুঝি তা না, কিন্তু অনুবাদের অনেক অনেক সীমাবদ্ধতা টের পাই।
Access 1 প্রোগ্রামে
আসলে সূরা ইয়াসীন করানোর কথা ছিল, কিন্তু সময়ে কুলাতে না
পেরে পরে সূরা হুজুরাত করানো হয়। এটা শুনে একটু দমে গিয়েছিলাম। কারণ সূরাটার বিশাল
ফ্যান ছিলাম এমন না। যখন অ্যাসাইনমেন্ট করেছি, তখন প্রতিটা
শব্দ বিশ্লেষণ করতে হয়েছিল। খুব ভালো লেগেছিল করতে, কিন্তু
নিজের তখন অসংখ্য ডেডলাইন ছিল, শুধু Grammatical
Analysis টাই করেছিলাম, শিক্ষা নিয়ে গবেষণা
করা হয় নি। মনের ভিতরে তীব্র আফসোস ছিল এজন্য। খালি মনে হত আমি যেন সূরাটার
প্রাণহীণ কংকাল নিয়েই নাড়া চাড়া করে গেলাম।
যাই হোক, এখন
সেমিস্টার ব্রেকে বসলাম শিক্ষাটা আত্মস্থ করবো বলে। শুরু করলাম উস্তাদ নুমানের
ক্লাসের রেকর্ডিংটা নিয়ে, যেটাতে ঊনি সূরাটার Internal
coherence পড়িয়েছেন। ঊনি আসলে এখন এই বিষয় নিয়েই গবেষণা করছেন।
ব্যক্তিগতভাবে এটা আমার কাছে খুব আকর্ষণীয় লাগে, কারণ আমি
মনে করি হাজার হাজার মানুষ কুরআনের অনুবাদ পড়ে কিছু বোঝে না/ মজা পায় না কারণ
অনুবাদে কুরআনকে আপাত দৃষ্টিতে খুবই খাপছাড়া লাগে (আস্তাগফিরুল্লাহ)। এই সূরাটাও বুঝতে বেশ
কষ্ট হচ্ছিল কারণ আয়াতগুলার মাঝে সংশ্লিষ্টতা বোঝার মত ঘিলু আমার নেই। উস্তাদের
ক্লাস করার পর সূরাটার শিক্ষা জীবনে বাস্তবায়ন করা এখন আমার অন্যতম দুআ হয়ে
গিয়েছে! এটার শিক্ষা লঙ্ঘন করা অবস্থায় আল্লাহ যেন আমাকে তুলে না নেন।
ঊস্তাদ যেভাবে পড়ালেন, সেটা
সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করছি-
সূরা হুজুরাতের ১৮টা
আয়াতকে ৩টা ভাগে ভাগ করা যায়। ১ম ভাগ হচ্ছে ১-৮ আয়াত।২য় ভাগ ৯-১২ আয়াত। আর শেষ ভাগ
হচ্ছে ১৩-১৮ আয়াত।
(আমি এখানে
মুহিউদ্দীন খানের অনুবাদ ব্যবহার করেছি)
১ম ভাগঃ
মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ ও
রসূলের সামনে অগ্রণী হয়ো না এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু শুনেন ও
জানেন। (1) মুমিনগণ! তোমরা নবীর
কন্ঠস্বরের উপর তোমাদের কন্ঠস্বর উঁচু করো না এবং তোমরা একে অপরের সাথে যেরূপ
উঁচুস্বরে কথা বল, তাঁর সাথে সেরূপ উঁচুস্বরে কথা বলো না।
এতে তোমাদের কর্ম নিস্ফল হয়ে যাবে এবং তোমরা টেরও পাবে না। (2) যারা আল্লাহর রসূলের সামনে
নিজেদের কন্ঠস্বর নীচু করে, আল্লাহ তাদের অন্তরকে
শিষ্টাচারের জন্যে শোধিত করেছেন। তাদের জন্যে রয়েছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার। (3) যারা প্রাচীরের আড়াল থেকে
আপনাকে উচুস্বরে ডাকে, তাদের অধিকাংশই অবুঝ। (4) যদি তারা আপনার বের হয়ে তাদের
কাছে আসা পর্যন্ত সবর করত, তবে তা-ই তাদের জন্যে মঙ্গলজনক
হত। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (5) মুমিনগণ! যদি কোন পাপাচারী
ব্যক্তি তোমাদের কাছে কোন সংবাদ আনয়ন করে, তবে তোমরা
পরীক্ষা করে দেখবে, যাতে অজ্ঞতাবশতঃ তোমরা কোন সম্প্রদায়ের
ক্ষতিসাধনে প্রবৃত্ত না হও এবং পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্যে অনুতপ্ত না হও। (6) তোমরা জেনে রাখ তোমাদের
মধ্যে আল্লাহর রসূল রয়েছেন। তিনি যদি অনেক বিষয়ে তোমাদের আবদার মেনে নেন, তবে তোমরাই কষ্ট পাবে। কিন্তু আল্লাহ তোমাদের অন্তরে ঈমানের মহব্বত
সৃষ্টি করে দিয়েছেন এবং তা হৃদয়গ্রাহী করে দিয়েছেন। পক্ষান্তরে কুফর, পাপাচার ও নাফরমানীর প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করে দিয়েছেন। তারাই সৎপথ
অবলম্বনকারী। (7) এটা আল্লাহর কৃপা ও নিয়ামতঃ
আল্লাহ সর্বজ্ঞ প্রজ্ঞাময়। (8)
আমরা যদি একটু যত্ন করে
লক্ষ্য করি তাহলে দেখবো যে এই ৮টা আয়াতের মূল থিমকে সংক্ষেপে বলা যায় ‘ রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের’ প্রতি সম্মান।
১ম ৫টা আয়াতের সুনির্দিষ্ট
শানে নুযূল আছে।কিছু বেদুইন ‘ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের
সাথে খুব casual behave করেছিল, মুহাম্মাদ
মুহাম্মাদ বলে জোরে জোরে ডাকছিল, যেভাবে নিজেরা কথা বলে।
সেটার প্রেক্ষিতে মূলত এই আয়াতগুলো নাযিল হয়। আমি বেকুব প্রথমে পড়ে ভাবছিলাম যে এই
আয়াতগুলার প্রয়োগ তো স্পেসিফিক, তাহলে আল্লাহ্ কেন এটা
কুরআনে উল্লেখ করলেন। পরে যখন বায়্যিনাহর ক্লাস করলাম, সেখানে
উস্তাদ ওয়াসিফ বুঝালেন যে আরবী শব্দগুলা এখানে আম (সাধারণ),খাস(
সুনির্দিষ্ট নয়)। যেমন ১ম আয়াতে তুক্বদ্দিমু (تُقَدِّمُوا ) এই ক্রিয়াটার কোনো object নাই,
মানে কী সামনে আগাবো না সেটা উল্লেখ না করে উন্মুক্ত রাখা হয়েছে।
এটা হতে পারে আপনার ইগো,ব্যবহার, আবেগ,
কণ্ঠ ইত্যাদি। আর তখনকার সময়ে এটা ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লামের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও আমাদের জন্য এটা প্রযোজ্য ঊনার
সামগ্রিক সুন্নাহের জন্য।
আমাদের মধ্যে একটা প্রবণতা
আছে যে অমুক তমুক তো ফরয না, সুন্নাহ।আমরা কেমন যেন সুন্নাহটাকে অবহেলা
করি। আমি অবশ্যই বলছি না সুন্নাহকে ফরযের গুরুত্ব দিতে হবে, কিন্তু
কোনো কিছু সুন্নাহ এটা শোনার পর সেটার প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়া কী হয় সেটা আবার
ভেবে দেখার অবকাশ আছে ইনশাল্লাহ। আরো বোঝা যায় যে আমরা ঊনাকে আর ১০টা মহামানবের
সাথে তুলনা করবো না, তাতেও ঊনার সম্মান ক্ষুণ্ণ হয়। এই আয়াত
পড়ে আমার সেটাই মনে হল। (And Allah knows the best)
উস্তাদ নুমান যখন বলছিলেন
যে ১-৮ এর থিম হচ্ছে ‘ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি সম্মান, তখন আমি
মনে মনে চিন্তা করছিলাম যে ৬ নং আয়াত কিভাবে এর মাঝে পরে! ঊনি সাথে সাথেই ব্যাখ্যা
করলেন যে কোনো তথ্য যদি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে আসে,
তাহলে আমাদের সেটার সত্যতা যাচাই করার দরকার নেই, অন্য কারো থেকে আসলে করতে হবে। মিডিয়ার কথা বিশ্বাস করার ক্ষেত্রে এই
আয়াতটা একটা বিশাল গাইডলাইন হতে পারে।
এখন আমাদের সময়ের জন্য আবার
অতিরিক্ত চ্যালেঞ্জ হচ্ছে যে আমাদের যাচাই করতে হবে যে ‘ রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে যা বলা হচ্ছে তা আসলেই সহীহ হাদীস কী না। আর এটা করার
জন্য হাদীস শাস্ত্রের মূলনীতিগুলো (উসূল আল হাদীস) জানাটা কেন যেন আমার কাছে খুব
খুব জরুরী মনে হয়।
এই সেকশনের যে আয়াতটা
আমাকে খুব আন্দোলিত করেছে সেটা হচ্ছে ৭ নং আয়াত। এখানে বলা হচ্ছে সুন্নাহর
ব্যাপারে আমাদের এই আস্থাটা থাকা উচিৎ যে সেটাতে যে গাইডলাইন দেয়া হচ্ছে সেটাই
আমাদের জন্য সবচেয়ে কল্যাণকর।
আমি এখানে আমার
প্রতিবেশীদের মাঝে যে ক্লাসটা নেই, সেখানে প্রায়ই ইসলামের নানা
আইনের প্রজ্ঞা নিয়ে আলোচনা হয়। আমি অনুভব করি যে আমি যেভাবে প্রজ্ঞাটা আত্মস্থ
করতে পেরেছি, আমি সেভাবে সুন্দর করে উপস্থাপন করতে পারছি না।
একটা বাঁধা খুব টের পাই- আমাদের অনুভূতি, আবেগ ইত্যাদি
যুক্তিকে ম্রিয়মান করে দিচ্ছে। একটা খুব কমন উদাহরণ হচ্ছে আমার স্বামী যদি আরেকটা
বিয়ে করেন তাহলে আমার খুব কষ্ট হবে। আল্লাহ্ এই কষ্টের কথা তো বুঝেন, তবুও কেন বহু বিবাহকে অনুমোদন দিলেন। যতই আমরা বুঝি যে এটা অনুমোদন দিয়ে
অনেক অনেক সামাজিক ইস্যুকে Address করা হয়েছে, আমাদের মাথায় যেন আটকে থাকে একটাই কথা- আমার তো অনেক খারাপ লাগবে!
এই প্রেক্ষাপটে এই আয়াতটা
যেন আমার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো যে আল্লাহর রাসূল যদি এভাবে আমাদের সবার
আবদার মেনে নিতেন (ব্যক্তি আমাদের ইচ্ছা অনিচ্ছা, ভালো লাগা না লাগা) ,
তাহলে সেটা আমাদের জন্যই কল্যাণকর হত না। আর এই যে ‘ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা, এই আয়াতে এখানে এটাকেই ‘ঈমান’ বলা হয়েছে। এটা কুরআনের আরেকটা অনন্য
বৈশিষ্ট্য। বিভিন্ন আয়াতে ঈমানের বিভিন্ন পিলারকে ঈমান হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
আমরা যদি খাপছাড়া ভাবে স্রেফ একটা আয়াতের দিকে তাকাই তাহলে মনে হবে এই একটা থাকলেই
বোধ হয় চলবে। কিন্তু আবারো- কুরআন পড়তে হবে Inherent consistency বিবেচনা করে, অতএব বিচ্ছিনভাবে একে দেখলে চলবে না :)
আর এইভাবে সুন্নাহ যে
সংরক্ষিত অবস্থায় আছে,
এটা আমাদের জন্য একটা বিশাল, বিশাল রহমত।
(চলবে)
২য় পর্বের লিংক
No comments:
Post a Comment