১ম পর্বের লিংকঃ
গত পর্বে বলেছিলাম যে আমি এখন অনুবাদের অনেক
সীমাবদ্ধতা বুঝতে পারি। ঠিক গত পর্বের অনুবাদেই এটার উদাহরণ আছে। লক্ষ্য করুন যে
প্রতিটা আয়াতের শুরু বলা হচ্ছে হে মুমিন গণ। এখন আরবীতে কিন্তু ইয়া মু’মিনুন নাই
(যেটার অর্থ হচ্ছে হে মুমিন গণ)। আরবীতে আছে ইয়া অ্যায়্যু হাল্লাযীনা আমানু, অর্থ্যাৎ
ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো। আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে এদের মাঝে পার্থ্যক্য কী,
কিন্তু আদতে এদের মাঝে পার্থক্যটা বিশাল। আরবী গ্রামার অনুসারে
মু’মিনুন একটা ইসম, যেটার মাঝে এক ধরণের permanence এর connotation আছে যা কালের সীমারেখার মাঝে বাঁধা
নয়। অন্যদিকে ইয়া অ্যায়্যু হাল্লাযীনা আমানু একটা ফি’ল যেটা বাংলায় ক্রীড়ার মত,
কালের আবর্তনে বাধা,স্থায়ী কিছু না। মানে আজকে
আপনি একটা কাজ করছেন মানেই যে কালকেও করবেন তা না। ঠিক সেরকম আজকে আপনি ঈমান
এনেছেন বলে যে এই অবস্থাতেই থাকবেন সেটার কোনো গ্যারান্টি নেই। আল্লাহ্
কুরআনে যখনই বিশ্বাসীদের আচরণগত গাইডলাইন দিয়েছেন, তখন তিনি
এভাবে ফি’ল form ব্যবহার করেছেন, ইসম
না।
এই কথাটা ইয়া অ্যায়্যু হাল্লাযীনা কাফারু এর
ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এটার মানে যারা এখন কুফরি করছো। এটার মানে না যে তারা এমনই
থাকবে। ‘কাফির’ যেটা একটা ইসম আর ইয়া অ্যায়্যু হাল্লাযীনা কাফারু বলার অর্থগত implication তা এক না।
১ম অংশের আয়াতগুলোর মাঝে যে অংশটা আমার কাছে
সবচেয়ে ভয়ের লাগে সেটা হল ২ নং আয়াতের শেষ অংশ যে ‘এতে তোমাদের কর্ম নিস্ফল হয়ে যাবে এবং তোমরা টেরও পাবে না।‘
এই একটা চিন্তা যে- কোনো আমল হয়তো আমার সব
কিছুকে বাতিল করে দিচ্ছে আমাদের অহংকার থেকে বাঁচাতে পারে। আমি প্রায়ই দুআ করি যে
এমন কিছু যেন না করি জীবনে যা অন্য সব আমলকে নিষ্ফল করে দিবো, আমি সেটা
টেরও পাবো না।(আল্লাহ মাফ করুন)
যাই হোক, ফিরে আসি মূল আলোচনাতে।
উস্তাদ ১ম সেকশন নিয়ে আলোচনা করার পর ২য় সেকশন নিয়ে আলোচনা না করে ৩য় সেকশনে চলে
গেলেন ইচ্ছা করেই, বললেন পরে ২য়টাতে ফিরে আসবেন। ৩য় সেকশনের
শুরু হয়েছে ১৩ নং আয়াত থেকে-
হে মানব, আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিতি হও। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত যে সর্বাধিক পরহেযগার। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবকিছুর খবর রাখেন। (13) মরুবাসীরা বলেঃ আমরা বিশ্বাস স্থাপন করেছি। বলুনঃ তোমরা বিশ্বাস স্থাপন করনি; বরং বল, আমরা বশ্যতা স্বীকার করেছি। এখনও তোমাদের অন্তরে বিশ্বাস জন্মেনি। যদি তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য কর, তবে তোমাদের কর্ম বিন্দুমাত্রও নিস্ফল করা হবে না। নিশ্চয়, আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম মেহেরবান। (14)তারাই মুমিন, যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি ঈমান আনার পর সন্দেহ পোষণ করে না এবং আল্লাহর পথে প্রাণ ও ধন-সম্পদ দ্বারা জেহাদ করে। তারাই সত্যনিষ্ঠ। (15)বলুনঃ তোমরা কি তোমাদের ধর্ম পরায়ণতা সম্পর্কে আল্লাহকে অবহিত করছ? অথচ আল্লাহ জানেন যা কিছু আছে ভূমন্ডলে এবং যা কিছু আছে নভোমন্ডলে। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সম্যক জ্ঞাত। (16) তারা মুসলমান হয়ে আপনাকে ধন্য করেছে মনে করে। বলুন, তোমরা মুসলমান হয়ে আমাকে ধন্য করেছ মনে করো না। বরং আল্লাহ ঈমানের পথে পরিচালিত করে তোমাদেরকে ধন্য করেছেন, যদি তোমরা সত্যনিষ্ঠ হয়ে থাক। (17) আল্লাহ নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের অদৃশ্য বিষয় জানেন, তোমরা যা কর আল্লাহ তা দেখেন। (18)
আমরা যদি এই আয়াতগুলা নিয়ে একটু চিন্তা করি, তাহলে
দেখবো যে এই সেকশনের মূল থিম হচ্ছে--‘আল্লাহর কাছে সম্মান অর্জন করার মূলমন্ত্র’।
প্রথমে আসি ১৩ নং আয়াতে। এখানেও অনুবাদে একটা
সীমাবদ্ধতা আছে। شُعُوبًا এবং وَقَبَائِلَ এই শব্দদ্বয়ের অনুবাদ
যথাক্রমে করা হয় জাতি ও গোত্র হিসেবে, যেটা আসলে পূর্ণাংগ অর্থ
প্রকাশ করে না। شُعُوبًا শব্দটার মাঝে একটা নেতিবাচক connotation আছে (মূল শব্দের অর্থ হচ্ছে ফাটল ওয়ালা দেয়াল) যেটা বুঝায় যে কোন জাতিই
আসলে perfect না। আর وَقَبَائِلَ
শব্দের আসল অর্থ হচ্ছে বংশলতিকা। অর্থ্যাৎ আমরা যদি আমাদের পূর্ব পুরুষের লিস্ট
বানাতে থাকি, তবে যা হবে আর কী। আর আমরা যদি পেছনে যেতেই
থাকি, আমরা কোথায় গিয়ে ঠেকবো? আদম
আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং হাওয়া, যাদের কথা আয়াতের শুরুতে বলা
হয়েছে......আর নিঃসন্দেহে তারা perfect ছিলেন না।
মূল বক্তব্য হচ্ছে এই আয়াত বংশমর্যাদা নিয়ে
গর্ব করার মূলে কুঠারাঘাত করছে। আল্লাহর কাছে সম্মানের
মূলমন্ত্র হচ্ছে তাক্বওয়া। এটা একই সাথে সকল Racism এর দ্বার বন্ধ করে
দিচ্ছে।আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কিভাবে এটার violation করি
তা বলতে গেলে তো মনে হয় মহাকাব্য হয়ে যাবে। অমুক নোয়াখ্যাইল্লা, তমুক এই, অমুক ফর্সা, তমুক
কালো .........and the list continues……...
১৪ নং আয়াতে মূলত একই থিম-ইসলাম হচ্ছে আমাদের
আচার প্রথা পালনের বাহ্যিক প্রকাশ, কার ঈমানের অবস্থা কী সেটা
আল্লাহই ভালো জানেন। বাইরের চাকচিক্য অর্থ্যাৎ আমলের বাহার দেখে কারো ব্যাপারে
ফাইনাল উপসংহারে পৌঁছানো উচিৎ না। কার পারলৌকিক পরিণতি কী হয়েছে তা আল্লাহই
একমাত্র জানেন। এ ব্যাপারে ‘রিয়া’ বা লোক দেখানো ইবাদাতের হাদীসটা আমরা মোটামুটি
সবাই জানি যা আত্মায় কম্পন ধরিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট হওয়া উচিৎ-
আবু হুরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ
(সাঃ) বলেছেন, ‘ক্বিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যে ব্যক্তির বিচার
করা হবে, সে হবে একজন (ধর্মযুদ্ধে শাহাদাত বরণকারী) শহীদ।
তাকে আল্লাহ্র নিকট উপস্থিত করা হবে। অতঃপর আল্লাহ্ পাক তাকে (দুনিয়াতে
প্রদত্ত) নেয়ামতসমূহের কথা স্মরণ করিয়ে দিবেন। আর সেও তা স্মরণ করবে। এরপর
আল্লাহ্ তাআলা তাকে জিজ্ঞেস করবেন, দুনিয়াতে তুমি কি আমল
করেছ? উত্তরে সে বলবে, আমি তোমার
সন্তুষ্টির জন্য (কাফেরদের সাথে) লড়াই করেছি। এমনকি শেষ পর্যন্ত শহীদ হয়েছি। তখন
আল্লাহ্ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ, বরং
তোমাকে যেন বীর-বাহাদুর বলা হয়, সেজন্য তুমি লড়াই করেছ। আর
(তোমার অভিপ্রায় অনুযায়ী) তোমাকে দুনিয়াতে তা বলাও হয়েছে। অতঃপর তার ব্যাপারে
আদেশ দেওয়া হবে। তখন তাকে উপুড় করে টেনে-হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
অতঃপর সে ব্যক্তিকে বিচারের জন্য উপস্থিত করা হবে, যে নিজে
দ্বীনী ইলম শিক্ষা করেছে এবং অপরকে শিক্ষা দিয়েছে। আর পবিত্র কুরআন অধ্যয়ন করেছে
(এবং অপরকে শিক্ষা দিয়েছে)। তাকে আল্লাহ্ পাকের দরবারে হাযির করা হবে। অতঃপর
তিনি তাকে নেয়ামতসমূহের কথা স্মরণ করিয়ে দিবেন এবং সেও তা স্মরণ করবে। অতঃপর আল্লাহ্
তাআলা তাকে জিজ্ঞেস করবেন, এই সমস্ত নেয়ামতের শুকরিয়া
জ্ঞাপনের জন্য তুমি কি আমল করেছ? উত্তরে সে বলবে, আমি স্বয়ং দ্বীনী ইলম শিক্ষা করেছি এবং অপরকে শিক্ষা দিয়েছি এবং তোমার
সন্তুষ্টির নিমিত্তে কুরআন তেলাওয়াত করেছি।
তখন আল্লাহ্ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। আমার
সন্তুষ্টির জন্য নয়, বরং তুমি এজন্য ইলম্ শিক্ষা করেছ,
যেন তোমাকে ‘বিদ্বান’বলা হয় এবং এজন্য কুরআন অধ্যয়ন করেছ, যাতে তোমাকে‘ক্বারি’ বলা হয়। আর (তোমার অভিপ্রায় অনুযায়ী ) তোমাকে
বিদ্বান ও ক্বারীও বলা হয়েছে। অতঃপর (ফেরেশতাদেরকে) তার সম্পর্কে নির্দেশ দেওয়া
হবে। সুতরাং তাকে উপুড় করে টানতে টানতে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
অতঃপর এমন এক ব্যক্তিকে বিচারের জন্য আল্লাহ্র দরবারে
উপস্থিত করা হবে, যাকে আল্লাহ্ তাআলা বিপুল ধন-সম্পদ দান করে বিত্তবান করেছিলেন। তাকে
আল্লাহ্ তাআলা প্রথমে প্রদত্ত নেয়ামতসমূহের কথা স্মরণ করিয়ে দিবেন। আর সে তখন
সমস্ত নেয়ামতের কথা অকপটে স্বীকার করবে। অতঃপর তিনি তাকে জিজ্ঞেস করবেন, এই সমস্ত নেয়ামতের শুকরিয়ায় তুমি কি আমল করেছ? উত্তরে
সে বলবে, যে সমস্ত ক্ষেত্রে ধন- সম্পদ ব্যয় করলে তুমি
সন্তুষ্ট হবে, তোমার সন্তুষ্টির জন্য সেসব খাতের একটি পথেও
ব্যয় করতে ছাড়িনি। আল্লাহ্ তাআলা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ।
আমার সন্তুষ্টির জন্য নয়; বরং তুমি এই উদ্দেশ্যে দান
করেছিলে, যাতে তোমাকে বলা হয় যে, সে
একজন ‘দানবীর’। সুতরাং (তোমার অভিপ্রায় অনুসারে দুনিয়াতে) তোমাকে ‘দানবীর’বলা
হয়েছে। অতঃপর (ফেরেশতাদেরকে) তার সম্পর্কে নির্দেশ দেওয়া হবে। নির্দেশ মোতাবেক
তাকে উপুড় করে টানতে টানতে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে । [মুসলিম]
আজকের সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে মনে হয় এই
ধার্মিক বেশ গ্রহণ করা সবচেয়ে সহজ। আমি ঠিক গত এক সপ্তাহের মাঝেই পর্ণ আসক্তির
জন্য সংসার ভেঙ্গে যাওয়ার কাহিনী শুনলাম ২টা। এর আগে শুনেছি আরো। দুঃখের ব্যাপার
হচ্ছে,
যাদের এমন অভ্যাস আছে, তাদের পাব্লিক লাইফ
ঈর্ষণীয় রকমের সুন্দর। গতকাল এখানে এক ফ্রেণ্ড তার অভিজ্ঞতার কথা বলছিল যে ওর
খ্রিস্টান ফ্রেণ্ড at that moment যে ছেলের সাথে ডেটিং করছিল,
ঘটনাচক্রে জানা গেল যে সে ওই শহরের MSA র একজন
active member, কুরআনে হাফিজ। তাই আমাদের পাব্লিক লাইফ যেমনই
হোক না কেন, প্রাইভেট লাইফ কেমন সেটা হচ্ছে আসল চ্যালেঞ্জ।
১৪ নং আয়াতে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ key পয়েন্ট
আছে যেটা এই থিমের সাথে সংশ্লিষ্ট। ‘যারা এরপর সন্দেহ প্রকাশ করে নি’- এই সন্দেহটা
কিন্তু অন্তরের ভিতরের খবর যেটার কথা আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউ জানেন না। তাই আমি
ইসলামের যা কিছু নিয়ে আমাদের সংশয় আছে সেটার পেটের মধ্যে না রেখে সেটা নিয়ে
আলোচনার পক্ষপাতী। আমরা নিশ্চয়ই জানি যে এই সন্দেহ ঈমান বিনষ্টকারী...আর কখনোই
নিজের ঈমান নিয়ে সন্তুষ্ট হওয়া যাবে না। মৃত্যুটা ঈমানের সাথে হওয়াটাই আসল
চ্যালেঞ্জ। এজন্য এই দুআটা খুব গুরুত্বপূর্ণ-
হে আমাদের পালনকর্তা! সরল পথ প্রদর্শনের পর তুমি আমাদের অন্তরকে সত্যলংঘনে প্রবৃত্ত করোনা এবং তোমার নিকট থেকে আমাদিগকে অনুগ্রহ দান কর। তুমিই সব কিছুর দাতা। (৩ঃ৮)
এরপরের সবগুলো আয়াতের মূল বক্তব্য মোটামুটি
একই-আল্লাহ ভিতর, বাহির সবকিছু জানেন। তাই কে
যে আসলে তাক্বওয়াবান তা আল্লাহর চেয়ে বেশী কেউ জানে না, বাইরের
অবস্থা যেমনই হোক না কেন।
এরপর উস্তাদ ২য় সেকশনে ফিরে এসেছেন। কেউ কী
আন্দাজ করতে পারবেন যে ২য় সেকশনের থিম কী ( ৯-১২ আয়াত)
১ম সেকশন রাসূলের মর্যাদা, শেষ সেকশন
আল্লাহর কাছে আমাদের মর্যাদা। তাহলে বাদ থাকলো কী যা মাঝখানে একদম পারফেক্টলি ফিট
করে?
No comments:
Post a Comment